মানুষ-হাতি মুখোমুখি
বন্য হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মানুষের মৃত্যু এবং মানুষের পাতা ফাঁদে পড়ে বন্য হাতির মৃত্যুর সংবাদে এটি এখন স্পষ্ট যে, মানুষ ও বন্য হাতি এখন মুখোমুখি। প্রশ্নটা একদিকে যেমন মানুষের জীবন-জীবিকার, তেমনি হাতির বেঁচে থাকার।
সবশেষ শনিবারও কক্সবাজারের উখিয়ায় বন্য হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে চার রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এর আগেও ওখানে একই ঘটনা ঘটেছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা উখিয়ার বনাঞ্চল ও পাহাড়ে বসতি স্থাপন করার পর থেকে এই ঘটনা বাড়ছে। অর্থাৎ বন্য হাতির আবাস ধ্বংস এবং তাদের চলাচলের পথে বসতি গড়ে তোলার খেসারত দিতে হচ্ছে মানুষের জীবন দিয়ে।
হাতির পাল মানুষের ফসলের জমি ও লোকালয়ে হানা দেয় বলে তারা মানুষের হাতে মারা পড়ে–এটি যেমন মুদ্রার একপিঠ, তেমনি অন্যপিঠ হচ্ছে হাতির খাবার ও আবাসন সংকট। বন্য প্রাণী তখনই লোকালয়ে আসে, যখন তার আবাস ও বিচরণস্থলেন সংকট তৈরি হয়। সেটি হতে পারে খাবার সংকট বা পরিবেশ সংকট। কিন্তু মানুষ যেহেতু হাতির চেয়ে বেশি শক্তিশালী, তাই তার জীবন মানুষের চেয়ে বেশি বিপন্ন। ফলে যখনই তারা নিজের জীবন বিপন্ন বোধ করে, তখন হানা দেয় লোকালয়ে, ফসলের জমিতে।
শেরপুরের বিভিন্ন এলাকায় ফাঁদ পেতে বন্য হাতি হত্যার খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে আসে। সীমান্তঘেঁষা নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলায় বন্য হাতির আনাগোনা সবচেয়ে বেশি। ধান পাকা শুরু হলে বা বিভিন্ন ফল বাগানে ক্ষুধার্ত হাতির দল মাঝেমধ্যেই হানা দেয়। তাই ফসল বাঁচাতে জেনারেটরে তার দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে ফাঁদ পেতে রাখে স্থানীয়রা। সেই ফাঁদে পড়ে মারা পড়ছে বন্য হাতি। আবার কীটনাশক লাগানো ধানের থোড় খেয়ে বা ধারালো অস্ত্রের আঘাতেও হাতির মৃত্যু হচ্ছে। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ২১ বছরে শেরপুর সীমান্তে অন্তত ৩০টি বন্য হাতির মৃত্যু হয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে বন্য হাতি হত্যা করলে সর্বনিম্ন দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও রাজনৈতিক নেতাদের চাপে থানায় সাধারণ ডায়েরি করা ছাড়া দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাচ্ছে না বলে স্বীকার করেছেন খোদ বন কর্মকর্তারাই। যদিও সম্প্রতি হাতির মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে একটি তদন্ত কমিটি করেছে শেরপুর জেলা প্রশাসন।
হাতির উপদ্রব থেকে বাঁচতে বিদ্যুতের তার দিয়ে যে ফাঁদ পাতা হয়, তাতে অনেক সময় সাধারণ মানুষের মৃত্যুও ঘটে। ২০১৫ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার কোদালা চা-বাগানসংলগ্ন গ্রামে হাতির জন্য দেওয়া বিদ্যুতের তারের ফাঁদে স্পৃষ্ট হয়ে বাবা-ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। তারা কোদালা চা-বাগানের শ্রমিক ছিলেন।
গত বছরের অক্টোবরে শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে হাতি তাড়ানোর এই ফাঁদে আবদুস সালাম নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। ঝিনাইগাতীর সীমান্তবর্তী জনপদে বন্য হাতির আক্রমণে নয়জন নিহত এবং ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পর বিক্ষুব্ধ লোকজন হাতি তাড়াতে জিআই তারের বৈদ্যুতিক ফাঁদ পাতে। এতে জড়িয়ে বেশ কয়েকটি বন্য হাতিও মারা পড়ে।
বস্তুত বন উজাড় হওয়ায় হাতির আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। অভাব দেখা দিয়েছে হাতির খাবারের। এ কারণে হাতির দল বাধ্য হয়ে লোকালয়ে আসছে খাবারের সন্ধানে এবং কখনো ফাঁদে পড়ে তাদের মৃত্যু হচ্ছে, আবার হাতির আক্রমণেও প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। সবশেষ শনিবার উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের ডি ব্লকের পাহাড়ি এলাকায় যে চার রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে তিনজনই শিশু।
মানুষের সঙ্গে হাতির এই মুখোমুখি অবস্থানে প্রাণ যাচ্ছে দুই পক্ষেরই। স্থানীয়রা থালাবাসন, ঘণ্টা বা বাঁশি বাজিয়ে ও মশাল জ্বালিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হয়, তখন বৈদ্যুতিক ফাঁদ পাতে। কিন্তু সেই ফাঁদে যখন ওই মানুষেরাই মারা পড়ে, তখন সেটি ‘পরের জন্য গর্ত খুঁড়লে নিজেকে পড়তে হয়’ প্রবাদের চিত্রায়ন হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষ ও বন্য প্রাণী কেন এমন মুখোমুখি দাঁড়াবে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে অভিযোগের তীর ওই মানুষের দিকেই যাবে।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের পাহাড় ও বনাঞ্চলের যে কী ভীষণ বারোটা বেজেছে, তার একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দিয়েছে চ্যানেল টোয়েন্টিফোর। ১২ অক্টোবর তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এরই মধ্যে উখিয়া-টেকনাফ এলাকায় এক হাজার ২০০ একর পাহাড় ও বন ধ্বংস হয়েছে। তা ছাড়া রোহিঙ্গারা প্রতিদিন জ্বালানি হিসেবে কমপেক্ষ পাঁচ লাখ কেজি বাঁশ ও কাঠ পোড়াচ্ছে। এর ফলে শুধু বন উজাড়ই নয়, ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গারা যে এলাকায় আবাস গড়ে তুলেছে, সেটি বন্য হাতির বিচরণস্থল। সুতরাং ভবিষ্যতে বন্য হাতির আক্রমণে আরো অনেক প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। আবার যখন বন্য হাতির আক্রমণে মানুষের এই মৃত্যু বাড়বে, তখন তারাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নানাবিধ ফন্দি আঁটবে, ফাঁদ পাতবে। তাতে মারা পড়বে এই বন্য প্রাণী।
সুতরাং এই সংকটের একমাত্র সমাধান হাতির আবাস ও বিচরণস্থলের কাছাকাছি মানুষের বসতি না গড়ে তোলা, বন উজাড় করে হাতির খাদ্যসংস্থান নষ্ট না করা। কেন না, হাতি যখন তার বিচরণ এলাকায় খাবার পাবে না, লোভী মানুষ যখন হাতির জীবিকায় হাত দেবে, হাতিও তখন দল বেঁধে মানুষের ফসলের জমিতে হানা দেবে, পায়ের তলায় নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষ পিষে মারবে, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত করে দেবে–এটাই স্বাভাবিক।
বন্য হাতি বনের ভেতরে নিরাপদ থাকুক। মানুষ নিরাপদে থাকুক বন্য প্রাণীর আক্রমণের হাত থেকে।
লেখক : সাংবাদিক