ছাত্রলীগের সেই নেতাদের কাছে জিম্মি ছিল সবাই
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় ধর্ষণের পর তরুণী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ছাত্রলীগের চার নেতার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে সবাই। পাথরঘাটা ডিগ্রি কলেজে আধিপত্য বিস্তার, শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করাসহ নানা অপরাধের সঙ্গে ওই চারজনের জড়িত থাকার একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিশেষ করে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রুহি আনাল দানিয়েল (২২) ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের (২১) একচ্ছত্র আধিপত্যের কাছে কলেজের সবাই এক রকম জিম্মি ছিল বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। কলেজের ভর্তি, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ, ফলাফলেও ছিল তাদের কঠোর হস্তক্ষেপ।
একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাথরঘাটা পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সত্তার মাস্টারের ছেলে দানিয়েল। তার ভাই মোফাসসের ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। পাথরঘাটা ডিগ্রি কলেজের ডিগ্রি চূড়ান্ত বর্ষে অধ্যয়নরত দানিয়েল স্থানীয় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়। এর পর পরই বেপরোয়া হয়ে ওঠে সে। কলেজ শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা থেকে শুরু করে আধিপত্য বিস্তারে বিরোধীদের দমন পীড়নে সিদ্ধহস্ত এই নেতার ভয়ে মুখ খোলেনি কেউ।
বরগুনায় ধর্ষণের পর তরুণী হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া পাথরঘাটা ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ছোট্টসহ দুই নেতাকে আজ সোমবার এভাবে কোমরে রশি বেঁধে স্পিডবোটে করে পাথরঘাটার আদালতে হাজির করা হয়। ছবি : এনটিভি
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাথরঘাটা ডিগ্রি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির মানবিক ও বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত বেশ কয়েকজন ছাত্র ও ছাত্রী জানায়, কলেজের ভর্তির পর পরই দানিয়েল ও সাদ্দাম সুন্দরী মেয়েদের প্রেমের প্রস্তাব দেয়। এতে রাজি না হলে পথে-ঘাটে উত্ত্যক্ত করা, হাত ধরে টানাটানি ও কলেজের তৃতীয় তলায় নিয়ে গিয়ে হুমকি দিত দানিয়েল। এমনকি অভিভাবকদের মুঠোফানে গালিগালাজ ও এবং টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকিও দিত সে।
এসব কাজে দানিয়েলের প্রধান সহযোগী কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ছোট্ট ও সাংগঠনিক সম্পাদক মহিদুল ইসলাম রায়হান। বিশেষ করে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার একাধিক অভিযোগ রয়েছে। সাদ্দাম পাথরঘাটা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবদুস সালামের ছেলে। সে একই কলেজের ডিগ্রি চূড়ান্ত বর্ষে অধ্যয়রনত।
পাথরঘাটা ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিদুল ইসলাম রায়হানের বাড়ি কাকচিড়া ইউনিয়নে।
গ্রেপ্তার হওয়া অপর ছাত্রলীগ নেতা উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক মো. মাহমুদ ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মিজানুর রহমানের ছেলে। মাহমুদ প্রথমে মাদ্রাসায় হাফেজি পড়লে পরে তা ছেড়ে দিয়ে পাথরঘাটা ফাজিল মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। বর্তমানে ওই মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিতে ফরম পূরণ করেছে। পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি বেলাল হোসেনের সঙ্গে বিরোধে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ায় পুলিশ তাকে আটক করলেও পরে ছেড়ে দেয়। এ ছাড়া মাহমুদ একজন মাদকাসক্ত হিসেবে পরিচিত।
শুধু শিক্ষার্থীই না, শিক্ষকদের ওপর এই ছাত্রলীগ নেতাদের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। এদের কথায় ভর্তি, পরীক্ষার হল নিয়ন্ত্রণ, রেজাল্ট এমনকি ক্লাস পর্যন্ত চালাতে বাধ্য হতেন শিক্ষকরা। এতে প্রতিবাদ করায় একাধিক শিক্ষক তাদের হাতে লাঞ্ছিতও হয়েছেন।
পাথরঘাটা ডিগ্রি কলেজের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত আগস্ট মাসে পরীক্ষার হলে কড়া পাহারা দেওয়ায় দানিয়েল, সাদ্দামসহ অন্য ছাত্রলীগ নেতারা ক্লাসে ঢুকে শিক্ষার্থীদের সামনেই প্রভাষক মিলন মিয়া ও সামসুল আলমকে লাঞ্ছিত করে।
বরগুনায় ধর্ষণের পর তরুণী হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া পাথরঘাটা ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রুহি আনাল দানিয়াল (মধ্যে)। ছবি : এনটিভি
পাথরঘাটা ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, গত পাঁচ বছর ধরে দানিয়েল ও সাদ্দাম এবং তার সহযোগীদের কাছে মূলত শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই জিম্মি ছিল। এদের ভয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মুখ খুলতে সাহস পায়নি। একাধিক শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার পর বিচার চেয়ে উল্টো তাদের দলীয় নেতাদের কাছে মাফ চাইতে হয়েছে।
ধর্ষণের পর তরুণীকে হত্যার ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন উপাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর।
এ বিষয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বসাক বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃতদের অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে আগে থেকেই জেলা পুলিশ অবগত রয়েছে। তদন্তের স্বার্থে সব কিছু এখন প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়ায় প্রকৃত অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে সম্ভব সব প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে বরগুনা জেলা পুলিশ।’
গত ১০ আগস্ট দুপুরে পাথরঘাটা ডিগ্রি কলেজের পশ্চিম পাশের পুকুর থেকে অজ্ঞাত পরিচয় এক তরুণীর গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় গত ১২ আগস্ট পাথরঘাটা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ। সেই থেকে এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে দীর্ঘ সময় ধরে লেগে থেকে এ মামলার রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হয় বরগুনা জেলা পুলিশ। সর্বশেষ রোববার বিকেলে পাথরঘাটার আদালতে ছাত্রলীগ নেতা মো. মাহমুদ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
এদিকে ছাত্রলীগ নেতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেছে স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতারা। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, বরগুনা জেলা শাখার উদ্যোগে সোমবার দুপুরে বরগুনা প্রেসক্লাব চত্বরে এ প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
বরগুনার পাথরঘাটায় ধর্ষণের পর তরুণী হত্যার প্রতিবাদে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আজ সোমবার মানববন্ধন করেন স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতারা। ছবি : এনটিভি
এদিকে গ্রেপ্তার হওয়া পাথরঘাটা ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রুহি আনাল দানিয়েল ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ছোট্টর দুই দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত। আজ সোমবার বিকেলে বরগুনা থেকে স্পিডবোটে করে তাঁদের দুজনকে পাথরঘাটার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করে সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। বিচারক মো. মঞ্জুরুল ইসলাম দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
যোগাযোগ করা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জুবায়ের আদনান অনিক বলেন, ‘এরই মধ্যেই চার ছাত্রলীগ নেতাকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ছাত্রলীগ কখনোই দুর্বৃত্তায়নের দায়ভার নেবে না। এসব একেবারেই তাদের ব্যক্তিগত অপরাধ। ঘটনায় যদি তারা সম্পৃক্ত থাকে তবে অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত।’