শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস
আর প্রশ্নহীন আনুগত্য নয়
আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এই দিনে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের, যাঁরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। যাঁদের সেদিন ধরে ধরে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম আর বিজয় অর্জনের পথে তাঁদের অবদান ছিল অসামান্য। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই তাঁরা পাকিস্তানিদের মুখোশ খুলে দেন এবং বৈষম্য ও শোষণের কথা জানিয়ে সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তোলেন। তাই তাঁরা পাকিস্তানি এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের চক্ষুঃশূল ছিলেন। নয় মাস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও খুনিরা যখন বুঝে যায় পরাজয় আসন্ন তখন তারা বাঙালি জাতিকে মেধা ও মননে পঙ্গু করে দেওয়ার শেষ অপচেষ্টায় নামে। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের ওপর। আর এই কাজে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চেয়েও বেশি ভূমিকা রাখে জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী এবং তাদের নিয়ে গঠিত রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের প্রাক্কালে দখলদার বাহিনী ও তার দোসররা পরাজয় নিশ্চিত জেনে মেতে ওঠে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তারা হত্যা করে জাতির অনেক কৃতী সন্তানদের। এর আরেকটি বড় উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা লাভ করতে যাওয়া একটি জাতিকে মেধাশূন্য করা। মুক্তিযুদ্ধে আমরা যাদের হারিয়েছি, নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন খ্যাতিমান। যুদ্ধে চারদিক থেকে কোণঠাসা হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা রাজধানীসহ মূলত শহরাঞ্চলে ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড চালায়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালির বিজয় অর্জনের ফলে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। আমাদের জন্য তা ছিল মহত্তম অর্জন। কিন্তু বিজয়ের আনন্দ অনেকটাই বিষাদে পরিণত হয় লাখ লাখ সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কারণে। এসব বুদ্ধিজীবীসহ ৩০ লাখ শহীদ ও অসংখ্য নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি প্রিয় মাতৃভূমি। প্রতিবারের মতো এবারও জাতি আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ওইসব মানুষকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। দাবি করবে তাদের হত্যার জন্য দায়ীদের বিচার।
বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকীতে এসে আসরা দেখি বাংলাদেশের আজ নানা ক্ষেত্রে সাফল্য। বেশিরভাগ সামাজিক ও আর্থিক সূচকে আমরা পাকিস্তানকে অনেক পেছেনে ফেলে এগিয়েছি। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা যে বাঙালি জাতিকে এক মহান স্থানে উত্তরণের লক্ষ্যে জীবন দিয়ে গেছেন, সেখানে আমরা পৌঁছুতে পারছি কি? বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মেধা ও মননে যেন এই দেশ পিছিয়ে থাকে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, রাজাকার, আলবদর আল-শামসদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। আজ শিক্ষাক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য শুরু হয়েছে তা আমাদের কোথায় নিয়ে চলেছে, তা ভাবলে সদুত্তর পাওয়া যায় না। প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষার নিম্নমান, পাঠবইয়ের সাম্প্রদায়িকীকরণের মাধ্যমে আমরা যেন বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের দর্শনের পথেই হেঁটে চলেছি। ধর্মের নামে হানাহানি, সঙ্ঘাতকে প্রায় নিয়মিত করে ফেলেছি পাকিস্তানিদের মতো।
স্বাধীনতার পরও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ, ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ডসহ অনেক ঘৃণ্য ঘটনা তাদের ষড়যন্ত্রের সাক্ষী হয়ে আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এখনো এ দেশে সেই হায়েনাদের কিছু অনুসারী আছে, যারা সেই বিচারের প্রতিবাদ করে, তাণ্ডব সৃষ্টির চেষ্টা করে। আমরা বলে আসছি, একাত্তরের ঘাতকদের ঘৃণা করতে হবে, তাদের প্রগতিবিরোধী চিন্তাচেতনাকে সচেতনভাবে বর্জন করতে হবে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বিপরীত সবকিছু দৃশ্যমান।
আমাদের সমাজে প্রগতিশীল, সামাজিক উদারবাদী, পরিবেশবাদী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বুদ্ধিজীবীর চেয়ে একটা চালাক চতুর শ্রেণির বুদ্ধিজীবীর আবির্ভাব ঘটেছে যারা সমাজের নিচের ধাপের, ক্ষমতাহীন সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণিগুলোর পক্ষে নেই। এরা বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোর ভেতরে থেকে সুবিধার সাগরে ভেসে বেড়ায়। কিভাবে সামাজিক-অর্থনৈতিক বঞ্চনাগুলো দূর করা যায় এবং বঞ্চিতরা নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রে অংশ নিতে পারে সেই ধরনের কথা এদের দিক থেকে উচ্চারিত হয় না।
এখনকার অনেক বুদ্ধিজীবীর ভণ্ডামি, একদেশদর্শিতা এবং অন্তঃসারশূন্যতা নিয়েও মানুষেরর মাঝে নানা ধরনের সমালোচনা আছে। রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে সমাজ যতটাই অসুস্থ হোক না কেন, একটা ক্ষমতার ক্ষীর-ননী খাওয়া নধর বুদ্ধিজীবী শ্রেণি সুস্থতার পথ দেখায় না বরং নানা ধরনের উৎসাহ দিয়ে পতনের গতিবৃদ্ধিতে নির্দেশিত করে। ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক লুটপাট, প্রশাসনিক অকর্মণ্যতা কিংবা সামাজিক অনাচারে, শিশুর মনোজগতে সাম্প্রদায়িকতা বীজ বপনে, শিক্ষাঙ্গন নষ্ট করে ফেলায়, নানা কুকর্মের বিস্তারে এসব বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদ তো দূরের কথা সামান্য সমালোচনাতেও তাদের আগ্রহ নেই।
আমাদের বুদ্ধিজীবী জগতে কিছুটা সত্য বলেন বামপন্থীরা। কিন্তু এরা নিজেদের মধ্যে প্রচণ্ড মতাদর্শগত লড়াইয়ে ব্যস্ত এবং এদের সাংগঠনিক পুষ্টিহীনতা প্রশ্নাতীত। প্রগতির বিপরীতে প্রতিক্রিয়াশীলতার বৃত্তটা এত বড় যে, এ রকম দুর্বল সাংগঠনিক পরিস্থিতি বামদের কোথাও দৃশ্যমান করছে না। সময়টা এমন যে, আদর্শে না হোক, অন্তত কৌশলগত কারণে হলেও এদের বন্ধুবৃত্তটা বাড়ানো দরকার, বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে এদের মাঝে ঐক্য দরকার।
ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বর আছে। কিন্তু লাঞ্ছনা ও অপমান ভয়ে এরা দূরেই থাকছে। এখন বুদ্ধিজীবী মানে হলো, বিভাজিত শিবিরের যে প্রান্তেই যে থাকুক, তাদের একমাত্র যোগ্যতা প্রশ্নহীন আনুগত্য। আজ যখন বুদ্ধিজিবী দিবস আবার আমাদের সামনে তখন প্রশ্ন উচ্চারিত হয় - এই ব্যাধির চিকিৎসা কী? বুদ্ধি নিষ্ক্রিয়তার রোগ বড় কঠিন। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা আবার শপথ নিন তারা সংকীর্ণতার আত্মঘাতী পথ থেকে তারা সরে আসবেন। উদার, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে, দরিদ্র, অবদমিত, ক্ষমতাবৃত্তের বহু দূরে থাকা নিষ্পেষিত মানুষের পক্ষে বুদ্ধিজীবীরা কণ্ঠ মেলাবেন।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি