অভিমত
ছায়েদুল হকের বাড়ি ‘শূন্যেরও মাঝার’
মন্ত্রীর বাড়ি বললে আমাদের চোখের সামনে বিশাল জায়গাজুড়ে যে অট্টালিকা, বাড়ির সামনে সবুজ লন, ভারী ধাতুর সুবিশাল গেট, গেটের সামনে সতর্ক প্রহরা এবং দামি সব ঝাড়বাতির কথা মনে আসে––সেই চিরায়ত ধারণার সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের দুটি বাড়ি কোনোভাবেই মেলে না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহর থেকে একসময় বিচ্ছিন্ন ছিল হাওর অধ্যুষিত এই নাসিরনগর। পরে জেলা-উপজেলার ব্যবধান ঘোচাতে একটি সড়ক নির্মাণ করেন এখান থেকে পাঁচবার নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছায়েদুল হক।
নাসিরনগর আলোচনায় আসে গত বছর। ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে ধর্মীয় অবমাননার কথিত অভিযোগের সূত্র ধরে এখানে বেশ কিছু মন্দির ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় আলোচিত হয় নাসিরনগর। যদিও পরে জানা গেছে, ফেসবুক স্ট্যাটাস ছিল আসলে উসিলামাত্র। মূলত ছায়েদুল হককে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতে ওই ঘটনায় উসকানি দেওয়া হয়েছিল।
আমরা যে বাড়ি দুটির কথা বলছি, তা এরই মধ্যে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এর মধ্যে একটি বসতঘর, অন্যটি আগেকার দিনের মিটিংরুম বা কাচারিঘর। দুটিই ছায়েদুল হকের বাবার আমলে তৈরি। পাঁচবার এমপি, একবার সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবং সবশেষ মন্ত্রী হওয়ার পরও নিজের জন্য একটি বাড়ি বানাতে পারেননি ছায়েদুল হক। তবে স্থায়ী বাড়িতে চলে গেছেন। অর্থাৎ মৃত্যুর পরে যে বাড়িতে মানুষকে নেওয়া হয়। ছায়েদুল হকের বিষয়টা অনেকটা হাছন রাজার ওই গানের মতো : ‘লোকে বলে, বলে রে ঘরবাড়ি ভালা না আমার, কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার।’
ছায়েদুল হক সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাব আমার ধারণা খুব ভালো ছিল না। নবম সংসদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। তখন নিয়মিত তাঁর ব্রিফিংয়ে উপস্থিত থাকতাম। কিন্তু তাঁর রুঢ় আচার-আচরণে সংসদ বিটের অনেক সাংবাদিকই তাঁর ওপর মনঃক্ষুণ্ণ ছিলেন। পরে অবশ্য জেনেছি যে, ব্যক্তিজীবনে তিনি সৎ এবং সম্ভবত এ কারণেই তিনি কাউকে পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করতেন না। গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনেই তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচরের জন্য এর চেয়ে সম্মানের বিদায় আর কী হতে পারে!
জীবদ্দশায় ছায়েদুল হক সম্পর্কে আর দশজনের মতো আমারও খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কিন্তু মৃত্যুর পরে আমরা যে ছায়েদুল হককে জানতে পারছি, তা শুধু বিস্ময়করই নয়, বরং আমাদের দেশের রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতা, এমপি-মন্ত্রীদের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার একেবারেই বিপরীত। তাঁর সম্পর্কে যেসব তথ্য এখন জানা যাচ্ছে, তার মধ্যে কয়েকটা এ রকম :
১. পাঁচবার এমপি এবং একবার মন্ত্রী থাকার পরও ঢাকায় কিংবা নির্বাচনী এলাকায় ছায়েদুল হক কোনো বাড়ি বানাননি বা বানাতে পারেননি। নির্বাচনী এলাকায় গেলে তিনি সাধারণত নাসিরনগরের ডাকবাংলোয় থাকতেন। কিন্তু কোনো কারণে বাড়িতে রাত্রিযাপন করতে হলে ঘরের ভেতরে দুটি কাঠের টেবিল জোড়া দিয়ে ঘুমাতেন। কারণ বাড়িতে কোনো খাট নেই।
২. যে অর্থ তিনি ভাতা পেতেন, তা নিজের ও পরিবারের জন্য খরচের পরে বাকি টাকা দিয়ে গরিব ও অসহায় মানুষকে সহায়তা করতেন। নিজের জন্য কোনো সম্পদ গড়েননি। বলতেন, দুনিয়ায় যা কিছুই করি, পরকালে তার সবকিছুর হিসাব দিতে হবে।
৩. কোনো উপরি আয় বা দুই নম্বরি ছিল না তাঁর। এমনকি একজন এমপি বা মন্ত্রীর বৈধ উপায়ে যে বাড়তি পয়সা আয়ের সুযোগ ছিল, ছায়েদুল হক তাও গ্রহণ করেননি। সবশেষ জানা যায়, তাঁর চিকিৎসার জন্য খোদ প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তিনি সেই টাকা গ্রহণ করেননি। বলেছেন, এত টাকা লাগবে না। কেননা সরকারি হাসপাতালে তিনি বিনা পয়সায়ই চিকিৎসা নিতে পারছেন। শুধু প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ছায়েদুল হক মাত্র ১০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন।
৪. চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি রিয়াজউদ্দিন জামির সঙ্গে আমার কথা হয় ছায়েদুল হকের সাদামাটা জীবনের নানা দিক নিয়ে। জামি বলেন, ২৫ বছর ধরে ছায়েদুল হককে চিনি। কোনোদিন তিনি কোনো সাংবাদিককে এক কাপ চা খাওয়াননি বা আমরাও তাঁকে কিছু খাওয়াতে পারিনি। কারণ তিনি কারো কাছ থেকে বিশেষ কোনো অনুকম্পা পেতে চাননি এবং সেটি তাঁর প্রয়োজনও ছিল না।
৫. ছায়েদুল হক কোনো ঘুষখোর লোকের বাড়িতে দাওয়াত খেতেন না।
৬. দেশের যেসব অঞ্চলে সুবিশাল জলমহাল আছে, তার সবখানেই নানারকম সংঘাত-সহিংসতা হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নাসিরনগর। ছায়েদুল হক প্রকৃত মৎস্যচাষিদেরই এই জলমহালের মাছ ধরার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তিনি পাঁচ হাজার কার্ড করে দিয়েছিলেন। শুধু দাস সম্প্রদায়ের লোকেরাই মাছ ধরতে পারেন। দেশের অন্যান্য জায়গায় জলমহালের ইজারা নিয়ে যে রকম কোটি টাকার বাণিজ্য হয়, নাসিরনগরে তার ছিটেফোঁটাও নেই। জলমহাল থেকে ছায়েদুল হক কোনোদিন ১০ টাকা নিয়েছেন, এরকম রেকর্ড নেই।
মৃত্যুর পরে আমরা এসব জানছি যে মানুষটির সম্পর্কে, তিনি ভিনগ্রহের কেউ ছিলেন না। তিনি আমাদেরই মতো রক্তমাংসে গড়া। কিন্তু তিনি যা পেরেছেন, জীবনকে তিনি যেভাবে দেখেছেন, রাজনীতির মতো জটিল ও কুটিল পথে থেকেও তিনি যেভাবে মানুষের সেবা করেছেন, যেভাবে নির্মোহ আর নির্লোভ থেকে পুরো জীবন অতিবাহিত করে গেছেন, তাঁর থেকে আমাদের রাজনীতিবিদরা কি কিছু শিখবেন?
লেখক : সাংবাদিক