২০১৮
ভোট ও শঙ্কার বছর
আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি নেবে না, এমন দোলাচলের মধ্যেই দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি অদ্ভুত মন্তব্য করেছেন। ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীতে কৃষকদলের আলোচনায় তিনি বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচনে বিএনপি অবশ্যই অংশ নেবে। বরং আওয়ামী লীগই হয়তো আসবে না।’
২০১৮ সালকে বলা হচ্ছে নির্বাচনের বছর। সঙ্গত কারণে শঙ্কার বছরও এটি। কেননা, ভোট মানেই যে হানাহানি, রক্তারক্তি আর নিরীহ মানুষের প্রাণহানি––সদ্য অনুষ্ঠিত রংপুর সিটির নির্বাচনের তার পুনরাবৃত্তি না ঘটলেও আগামী ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে উপনির্বাচন এবং মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে মেয়াদোত্তীর্ণ বাকি সিটি করপোরেশন এবং বছর শেষে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে রংপুরের মতো শান্তিপূর্ণ পরিবেশ কতটা বজায় থাকবে, তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট কারণ আছে।
অবস্থাদৃষ্টে যদিও মনে হচ্ছে যে, ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ হবে। এরইমধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ব্যবসায়ী নেতা আতিকুল ইসলাম এবং বিএনপির প্রার্থী হিসেবে গতবারের মতোই আরেক ব্যবসায়ী নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আউয়ালের নাম শোনা যাচ্ছে। জনপ্রিয় ব্যান্ডদল মাইলসের শাফিন আহমেদও জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) প্রার্থী হয়ে লড়বেন বলে শোনা যাচ্ছে।
তবে ভোটের ফল যা-ই হোক, ধারণা করা যায়, জাতীয় নির্বাচনের বছরে ঢাকা সিটির এই উপনির্বাচনও রংপুরের মতো অবাধ ও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকার তার রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিচয় দেবে। কেননা, ঢাকার এই নির্বাচনে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার বা জোরজবরদস্তি আখেরে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে এবং বিএনপির নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিকে আরও বেশি যৌক্তিক করে তুলবে। সাধারণ মানুষও তাদের এই দাবির সাথে একাত্ম হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত রাজনীতির যে হাওয়া, তাতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নয়, বরং দলীয় সরকারের অধীনে এবং শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই একাদশ জাতীয় নির্বাচন হবে বলে মনে হচ্ছে। যদি সেটি করতে হয় তাহলে সরকারকে সিটি করপোরেশন নির্বাচগুলোয় নিজেদের নিরপেক্ষ এবং নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।
ভোট মানেই কেন শঙ্কার? বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন? রংপুরে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে গেলেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, গণতন্ত্রের জয় হয়েছে। এ কথা তিনি বলতে পেরেছেন এ কারণে যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বা একটি দুটি সিটি করপোরেশনে সরকার দলীয় প্রার্থীরা হেরে গেলেও তাতে সরকার বদল হয় না। স্থানীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা হেরে গেলে তৃণমূলে বিরোধীরা শক্তিশালী হয় এ কথা ঠিক, কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের চরিত্র এবং গুরুত্ব আলাদা। ওই নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর কোনো দলই বলে না যে, আমরা হেরে গেলেও গণতন্ত্রের জয় হয়েছে। বরং হেরে যাওয়া বা হেরে যাওয়ার আভাস পাওয়ার পরই কারচুপির অভিযোগ আনা হয়। ভোট বর্জনও হয়।
রংপুরে যে সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে তাই নয়, বরং বিজয়ী প্রার্থী পরাজিত প্রার্থীদের বাসায় ফুলের মালা নিয়ে গিয়েছেন এবং কুশল বিনিময় করেছেন। নগরীর উন্নয়নে তাদের সমর্থন ও সহায়তা চেয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরে ঘটে ঠিক তার বিপরীত। পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা, আগুন, মামলার পর মামলা, খুন ইত্যাদি বেশ পরিচিত দৃশ্য। সুতরাং রংপুরের নির্বাচন দিয়ে আমরা জাতীয় নির্বাচনকে তুলনা করতে পারি না। যে কারণেই আসে শঙ্কার কথা।
রংপুরে কেন এরকম একটি নির্বাচন হতে পারলো এবং জাতীয় নির্বাচনে কেন হয় না? জবাব পরিস্কার। প্রথমত এই নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু করতে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল। আমরা যতই বলি না কেন নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী হলেই ভালো নির্বাচন সম্ভব; এ কথা আংশিক সত্য। বাস্তবতা হলো, নির্বাচন কমিশনে যত সাহসী ও নিরপেক্ষ লোকেরা দায়িত্ব পালন করুন না কেন, সরকার যদি মনে করে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করবে বা ভোটের ফলাফল নিজেদের অনুকূলে রাখবে, তখন কমিশনের কিছুই করার থাকবে না। অ্যাকাডেমিক্যালি ভোটের সময় মাঠ প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের কথায় চলে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সব সরকারের আমলেই প্রশাসনে নগ্ন দলীয়করণ চলে। আমলা ও পুলিশের সুযোগ-সুবিধা অব্যাহতভাবে বাড়ানো হয়। ফলে ভোটের সময়, বিশেষ করে করে জাতীয় নির্বাচনের সময় এই আমলাতন্ত্র ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষে নির্বাচনের কমিশনেরে নির্দেশ মেনে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করা কঠিন। রংপুরের মাঠ প্রশাসনের ওপর কোনো রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক চাপ ছিল না। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে। নির্বাচন কমিশনের ওপর কোনো খবরদারি ছিল না। দেশের সবগুলো গণমাধ্যমের ক্যামেরা সেখানে ছিল। ফলে কোনো ধরনের অনিয়ম চোখ এড়ানোর সুযোগ ছিল না। সর্বোপরি সেখানে সব দলের অংশগ্রহণ ছিল।
কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে এই বিষয়গুলোর নিশ্চয়তা পাওয়া কঠিন। যেহেতু একইদিনে ৩০০ আসনে ভোট হয়, তাই একসঙ্গে কোনো গণমাধ্যমের পক্ষেই সবগুলো আসনে নজর দেয়ার সুযোগ থাকে না। গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলোয়ই তারা তৎপর থাকে।
একটি বা দুটি জায়গায় যখন ভোট হয়, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য সেখানে নিয়োগ করার সুযোগ থাকে। ফলে বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা হলেও তা সহজে দমন করা যায়। কিন্তু একসঙ্গে ৩০০ আসনে নিয়োগের মতো এত জনবল এখনও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। ফলে অনেক আসনেই কেন্দ্র দখল, ভোটারদের আসতে বাধা দেয়া কিংবা ব্যালট বাক্স লুটের মতো ঘটনা ঘটলেও, সব সময় তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
সুতরাং আগামী জাতীয় নির্বাচন রংপুরের মতোই অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হবে, সাধারণ মানুষের এই প্রত্যাশা থাকলেও সেটি অনেক কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং।২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তৎকালীন বিরোধী দলের ডাকা হরতাল-অবরোধের নামে সহিংসতার স্মৃতি মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। ফলে আবারও যখন রাজনীতির দরজায় জাতীয় নির্বাচন কড়া নাড়ছে, তখন সেই নৃশংসতার ছবিগুলোই ভেসে উঠছে মানসপটে।ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতায় থাকার নির্মম রাজনীতির শিকার সাধারণ মানুষ তাই ভোটের কথা শুনলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারপরও ২০১৮ সাল বাংলাদেশের মানুষের জন্য শান্তির বার্তা বয়ে আনুক, এই প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক।