বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
স্বাধীন বাংলাদেশের দৃঢ় ভিত্তি
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল ইতিহাসের অনিবার্য উপাদান। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে বন্দি থাকলেও তাঁর নামেই ন’মাস মুক্তিযুদ্ধ চলে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকারও বঙ্গবন্ধুকে প্রধান করেই গঠন (১৭ এপ্রিল, ১৯৭১) করা হয়েছিল। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরও বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকার মাটিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে সে শঙ্কা দূরীভূত হয়। বিখ্যাত ব্রিটিশ পত্রিকা The Guardian-এ ১০ জানুয়ারি Recognize Bangladesh Now শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়- ‘Once Sheikh Mujibur Rahman steps out of Dacca Airport, the new republic becomes a solid fact’।
১৬ ডিসেম্বর বিকালে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় জায়গা ঢাকার তদানিন্তন রেইসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানী জেনারেল নিয়াজি যখন আত্মসমর্পন করে বন্দিত্ব বরণ করেন ঠিক সেই সময়টাতেও নিয়াজির নিজ শহর মিয়ানওয়ালী সেন্ট্রাল জেলে বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সহজে অন্যকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতার বাইরেও শারীরিক গঠন, সুন্দর উচ্চারণে উর্দু বলতে পারা এবং নামের আগে ‘শেখ’ থাকায় মিয়ানওয়ালীর জেলের ডিআইজি শেখ আব্দুর রশিদের সাথে বঙ্গবন্ধুর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশে আটকাপড়া নিয়াজির শহরে শেখ মুজিবের জন্য নিরাপদ মনে করেননি ডিআইজি শেখ আব্দুর রশিদ। শেখ আব্দুর রশিদ বঙ্গবন্ধুকে একটি রেস্ট হাউজে নিয়ে যান। কয়েকদিন পর কর্নেল আবদুল্লাহর নেতৃত্বে পাকিস্তানী কমান্ডোরা হেলিকপ্টারে তুলে নিয়ে যান সিহালা রেস্টহাউজে। সেখানেই পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো আসেন দেখা করতে। ভুট্টোকে দেখেই বঙ্গবন্ধু রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘তুমিও বন্দি নাকি?’ ভুট্টো বলেছিলেন, ‘না না, আমি এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট’। ভুট্টোকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ আমি বন্দি না মুক্ত?’ ভুট্টো বলেন, ‘মুক্ত’। বঙ্গবন্ধু বলেন তাহলে আমাকে বাংলাদেশে যেতে দাও। ভুট্টো বলেন, শীঘ্রই তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।
মিয়ানওয়ালীতে বঙ্গবন্ধুর জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছিল এবং সেখানে সংক্ষিপ্ত সামরিক ট্রায়ালের সময় বঙ্গবন্ধু জেনেছিলেন, ড. কামাল হোসেন পাকিস্তানে বন্দি। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে হরিপুর জেল থেকে কামাল হোসেনকে সিহালা রেস্ট হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। ডিসেম্বর মাস শেষ হতে থাকলেও বিভিন্ন অজুহাতে বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরা বিলম্ব হতে থাকে। এর মধ্যে ভুট্টোর এক ভগ্নিপতি মারা গেলে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ ফেরা আরও বিলম্বিত হয়। বঙ্গবন্ধু সরাসরি বাংলাদেশে ফিরতে চেয়েছিলেন। পিআইএ-এর প্লেন ভারতীয় সীমানার উপর দিয়ে চলাচলের নিষেধাজ্ঞা থাকায় বঙ্গবন্ধুকে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমে তেহরান পরে সুইজারল্যান্ড, শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছাতেই লন্ডনে যাওয়ার বিষয়টি স্থির হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বাইরে কলকাতার পরেই লন্ডনে আমাদের সবচেয়ে বেশি সমর্থক ছিল, তাছাড়া বঙ্গবন্ধু নিজেও আগে সেখানে গেছেন।
লন্ডনে অবতরণের মাত্র ত্রিশ মিনিট আগে সেখানকার টাওয়ারকে বঙ্গবন্ধুর আগমনের কথা জানান একই প্লেনে আসা পিআইএ এর চিফ এয়ার ভাইস মার্শাল জাফর চৌধুরী। এয়ারপোর্ট থেকে ব্রিটিশ ফরেন অফিসকে খবরটা জানালে দক্ষিণ এশিয়া ডেস্কের কর্মকর্তা ইয়ান মাদারল্যান্ড এয়ারপোর্টে আসেন। হিথ্রো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বসানো হয়েছিল ‘আলকক এন্ড ব্রাউন’ ভিআইপি স্যুইটে। বঙ্গবন্ধু ইয়ান মাদারল্যান্ডের কাছে বাংলাদেশ মিশন প্রধান আবু সাঈদ চৌধুরীর ফোন নম্বর চান। আবু সাঈদ চৌধুরী ৫ জানুয়ারি ঢাকায় চলে আসেন। মিশন প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন এএমএম রেজাউল করিম। রেজাউল করিমের সাথে বঙ্গবন্ধু ফোনে কথা বলেন। এয়ারপোর্টে ছুটে আসেন রেজাউল করিম। তাকে অনুসরণ করে পরপরই এয়ারপোর্টে পৌছান দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সেক্রেটারি মহিউদ্দিন ও মহিউদ্দিন জায়গিরদার। এয়ারপোর্টে এসে রেজাউল করিম বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কোথায় যাবেন? বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট হোটেলের কথা বলেছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি লন্ডনে গিয়ে রাসেল স্কয়ারের এই হোটেলটিতেই ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকে মাদারল্যান্ডের বরাত দিয়ে জানানো হয়, ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছেন। যার কারণে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে প্রেসিডেন্ট হোটেলে রাখা যাবে না। এয়ারপোর্ট থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য নির্ধারিত অধিক নিরাপত্তা বেষ্টিত ক্ল্যারিজেস হোটেলে । হিথ্রো থেকে ক্ল্যারিজেস হোটেলে বঙ্গবন্ধুকে নেওয়ার জন্য লিমুজিনের ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু পরে বঙ্গবন্ধুর জন্য রেজাউল করিমের ফোর্ড কাটিনা নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ মনে করা হলো। বিমানবন্দরে উপস্থিত মিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি মহিউদ্দিনের গাড়িতে নেয়া হয় বঙ্গবন্ধু ও ড. কামালের স্যুটকেস।
৮ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছান, সেদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ লন্ডনের বাইরে ছিলেন। তিনি সফর সংক্ষিপ্ত করে বঙ্গবন্ধুর জন্যই সন্ধ্যায় লন্ডনে ফিরে আসেন। রাতে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের দুয়ারে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়ি থামলে, একটি লোক এসে গাড়ির দরজা খুললেন এবং বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে না আসার পর্যন্ত দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি আর কেউ নন, গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে এক ঘণ্টার বৈঠকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে যুক্তরাজ্য কর্তৃক স্বীকৃতির বিষয়টি উত্থাপন করেন। পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় তাঁর জীবন রক্ষার প্রচেষ্টার জন্য বঙ্গবন্ধু এডওয়ার্ড হিথকে ধন্যবাদ জানান।
৯ জানুয়ারি টেলিফোনে ইন্দিরা গান্ধী-বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আধা ঘণ্টা আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা যাওয়ার পথে দিল্লীতে যাত্রাবিরতির অনুরোধ করলেন। ইন্দিরা গান্ধী প্রথমে ভারতীয় বিমানের ব্যবস্থা করলেও হিথের পরামর্শে ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের জেটে করেই বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সাইপ্রাস ও ওমান হয়ে বিমান দিল্লীতে অবতরণ করলে প্রেসিডেন্ট শ্রী ভরাহগিরি ভেঙ্কটগিরি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে স্বাগত জানান। তখন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় একুশ বার তোপধ্বনি করা হয়। গার্ড অব অনার প্রদান ও ফুলের পাপাড়ি বর্ষণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু অভিবাদন মঞ্চে উঠলে গুর্খা বাদক দল বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ বাজাতে শুরু করে। পালাম বিমানবন্দরের স্বাগত ভাষণে ভি.ভি গিরি বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এই অঞ্চলের স্থায়ী ও অটুট শান্তি প্রতিষ্ঠা, প্রত্যাশা ও সম্ভাবনা জোরদার ও সুনিশ্চিত করবে।’
প্রেসিডেন্ট গিরিরস্বাগত ভাষণের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমার জন্য এই ক্ষণ অত্যন্ত আনন্দের। বাংলাদেশে ফেরার পথে আমি আপনাদের মহান দেশের এই ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ, আপনাদের মহিমান্বিত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন এই সরকার ও ভারতের জনগণ যাঁরা আমার জনগণের উত্তম বন্ধু তাঁদের প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এটি হলো আমার ন্যূনতম করণীয়। ... নয় মাস পরে আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় আমি অবশেষে ফিরে যাচ্ছি। এই নয় মাসে আমার জনগণ বহু শতাব্দী অতিক্রম করেছে।”
নয়াদিল্লির জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জনগণের নিকট স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং তিনি তা তাঁদের এনে দিয়েছেন। ভারত অঙ্গীকার করেছিল বাংলাদেশকে মুক্ত করবে, মুজিবকে মুক্ত করবে, এবং সবশেষে শরণার্থীদের তাদের ভিটেমাটিতে পাঠিয়ে দেবে। তিনি বলেন, “আমাদের প্রতিশ্রুতি আমরা পালন করেছি।” নয়াদিল্লির বিশাল জনসভায় জনতার উদ্দেশে আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, “বাংলাদেশ ও তার জনগণ আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, সরকার, সশস্ত্রবাহিনীর বীর সদস্যবৃন্দ এবং আপনাদের সাধারণ মানুষকে কোন দিনই ভুলতে পারবে না, যাঁরা তাদের দুঃখ-দুর্দশায় এবং সংগ্রামে সর্বাত্মক সহানুভূতি প্রদর্শন ও সমর্থন দান করেছেন। ২০টিরও অধিক দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধিবৃন্দ যাঁদের অধিকাংশই রাষ্ট্রদূত, বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধি ছিলেন সোভিয়েত ব্লকের। ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালি, পশ্চিম জার্মানি, নরওয়ে এবং ডেনমার্কের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। বিমানবন্দরের অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও আরবদের কোন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না।
নয়াদিল্লির জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ ইংরেজিতে শুরু করেছিলেন। শুরুতে জনতার মধ্য থেকে চিৎকার ভেসে আসে বাংলায় বলার জন্য। হাসি দিয়ে সম্মতি প্রকাশ করে তিনি তাঁর মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিতে শুরু করেন। আর জনতা মহোৎসাহে তাদের সমর্থন জানায়। আনুষ্ঠানিকতার পর ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে যান বঙ্গবন্ধু। দিল্লি অবতরণের পূর্বেই বিমানে থাকা অবস্থায় তাঁর সফরসঙ্গী ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা শশাঙ্ক এস. ব্যানার্জির মাধ্যমে ভারতকে জানিয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা বঙ্গবন্ধুর কাছে সবচেয়ে জরুরি। পরামর্শকদের সাথে আলোচনার শুরুতেই ইন্দিরা গান্ধী জানালেন মুজিবের প্রস্তাবে তিনি রাজি। যথাসময়ে ইন্দিরা-মুজিব বৈঠক শুরু হল। ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি ইন্দিরা-মুজিব যৌথ ইশতেহারে স্থান পেল। প্রথমে কথা ছিল ভারতের সৈন্য প্রত্যাহারের তারিখ হবে জুন, ১৯৭২। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় তা হল মার্চ, ১৯৭২। আজকাল কোন দেশে শত্রু অথবা মিত্র হিসেবে অন্য দেশের সৈন্য ঢুকতে দেরি না হলেও বেরোতে অনেক দেরি হয়। আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র বাংলাদেশ থেকেই তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য অপসারিত হয়। এই অসম্ভবই সম্ভব হয় একমাত্র বঙ্গবন্ধুর জন্য।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বিকালে বঙ্গবন্ধু লন্ডন দিল্লি হয়ে প্রাণের শহর ঢাকা ফিরে আসেন বেলা ১টা ৪১ মিনিটে। ঢাকায় অবতরণের পূর্বে কমেট বিমানটি বঙ্গবন্ধুর অভিলাষের প্রতি শ্রদ্ধাবশত প্রায় ৪৫ মিনিট বিমানবন্দরের উপর চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। ওপর থেকে তাঁর “সোনার বাংলা”কে অবলোকন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। অভ্যর্থনায় অনেক কূটনীতিক এলেও চীন ও ইরানের কনসাল জেনারেলদ্বয় অনুপস্থিত ছিলেন, তবে যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বার্ট ডি. স্পিভাক এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে করমর্দন করার সময় সৌজন্য প্রকাশের জন্য সামান্য অবনত হন এবং বলেন “ঢাকায় স্বাগতম”। বঙ্গবন্ধু হেসে উত্তর দেন, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ”।
বিমানবন্দর থেকে লাখো জনতার ভিড় ঠেলে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে। সেদিন রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন, তাঁর দুই চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়ছিল বারবার। তিনি কান্নারত কণ্ঠে বলেন, “বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি, বিশ্বকবি তোমার সেই আক্ষেপ মিথ্যা প্রমাণিত করে সাত কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে।” আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার মত করে নির্মিত ১০০ ফুট দীর্ঘ মঞ্চ থেকে ৩৫ মিনিটের ভাষণে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম, তোমরা আমাকে মারতে চাও মেরে ফেলো। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালিদের কাছে ফিরিয়ে দিও...। আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, জীবন দেবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, মানুষ একবারই মরে... মরার আগে বলে যাব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, জয় বাংলা...।’
বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, “গত ৭ মার্চ আমি এই রেসকোর্সে বলেছিলাম ‘দুর্গ গড়ে তোলো’। আজ আবার বলছি আপনারা একতা বজায় রাখুন। আমি বলেছিলাম, ‘বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো “ইনশাল্লাহ”। বাংলাদেশ আজ মুক্ত স্বাধীন। ...আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয় নেতা হিসেবে নয় আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি ... যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায় তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে- পূর্ণ হবে না। ...বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয় ভিত্তি হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।”
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়