যুদ্ধকথা
দুবার ধরা পড়ে রক্ষা পাই : আমিনুর রহমান ফরিদ
আমিনুর রহমান ফরিদ, ফরিদপুরের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, উনিশশ একাত্তরে স্বাধীনতার জন্য যিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তখন তিনি কলেজে পড়েন, দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে ফরিদপুর অঞ্চলে যুদ্ধে অংশ নেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণ নিয়ে তিনি এনটিভি অনলাইনে বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রদান করেন, যেখানে তিনি তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও নানা স্মৃতিচারণ করেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন মেহেদী হাসান।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আমিনুর রহমান ফরিদ বলেন, ‘উনিশশ একাত্তর বাঙালির জন্য এক স্মরণীয় বছর। আমি তখন ফরিদপুরে ইয়াসিন কলেজে পড়ি। মার্চ মাসের ২ তারিখে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলে ভীষণভাবে আমরা আলোড়িত হই। আর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর আমাদের বুঝতে বাকি থাকেনি যে স্বাধীনতার জন্যই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সে সময় ফরিদপুরে আমাদের নেতৃবৃন্দ যাঁরা ছিলেন, যেমন সামসুদ্দিন মোল্যা, ওয়ায়দুর রহমান, ইমামউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ স্বাধীনতার বিষয়ে আমাদের ওয়াকিবহাল করেন। আমরা তখন ফরিদপুরেই ট্রেনিং নিতে থাকি। ২১ এপ্রিল ফরিদপুর আঙিনা পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হলে আমি তখন সালথায় চলে আসি। এরপর বাড়িতে গিয়ে এক রাত থেকে ভোরবেলা যুদ্ধে অংশ নিতে চলে যাই।’
আমিনুর রহমান ফরিদ মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দিন গ্রুপে যোগদান করেন। তাঁদের ক্যাম্প ছিল বোয়ালমারীর নতুবদিয়া। ৯ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে বড় রকম সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন তাঁরা। সেই স্মৃতিচারণ করে আমিনুর রহমান ফরিদ বলেন, ‘৯ ডিসেম্বর। বোয়ালমারী নতুবদিয়া ক্যাম্পে ইন্ডিয়া থেকে আনা বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র দেখছিলাম। হঠাৎ খবর আসে গ্রামের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আসছে। তাৎক্ষণিক আমরা প্রতিরোধ করবার জন্য প্রস্তুতি নিই। একটা সেনাবাহিনীর জিপ রাস্তা দিয়ে গেলে আমরা আক্রমণ করি। জিপে দু-এককজন সিপাহি ছিল মাত্র। হঠাৎ আক্রমণে জিপচালক গাড়ি নিয়ে দ্রুত ফিরে যায়। আমরা এরপরও অপেক্ষা করছি। আধা ঘণ্টার মধ্যেই দেখি, আরো অনেক সেনাবাহিনী এসে হাজির। তখন দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ লাগল। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে যুদ্ধ। সন্ধ্যা হয়ে গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীরা চলে যায়। এ যুদ্ধে ওদের ২৫-৩০ জনের মতো মারা গেছে, আমাদেরও সাতজনকে আর খুঁজে পাইনি। যারা আহত হয়েছে, তাদের আমরা রস জাল দেওয়ার তাফালে করে নতুবদিয়া ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনি।’
দুবার রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে রক্ষা পান আমিনুর রহমান ফরিদ। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের মাঝখানে একবার বাড়িতে গিয়েছিলাম নীলটুলিতে। মা আমাকে দুধ-ভাত খেতে দিল। হঠাৎ আমার বড় ভাইয়ের মুখে শুনি রাজাকাররা বাসার সামনে টহল দিচ্ছে, আমাকে খুঁজছে। তখন বাড়ির সীমান্ত বেড়ার ভেঙে ফাঁক দিয়ে কোনোরকমে পালিয়ে আসি। এরপর আরো একদিন ধরা পড়ি শান্তি কমিটির সদস্যদের কাছে। সে যাত্রায়ও রক্ষা পাই। মহিউদ্দিন আহমেদ নামের একজন আমাকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেন। তিনি নাটক করতেন। যদিও তিনি পাকিস্তানপন্থী ছিলেন, রাজাকার ছিলেন। রিকশায় করে তিনি আমাকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেন। এভাবে দুবার ধরা পড়ে রক্ষা পাই।’
যখন শুনলেন দেশ স্বাধীন হয়েছে, তখন কেমন অনুভূতি হলো—জানতে চাইলে আমিনুর রহমান ফরিদ বলেন, ‘সে অনুভূতি বলে প্রকাশ করা যাবে না। দেশ স্বাধীন হলে আমরা ফিরে এলাম শহরে। ফরিদপুর তখনো পুরো শত্রুমুক্ত হয়নি। ১৭ ডিসেম্বর সর্বশেষ যুদ্ধ হয়, সেটিই ছিল শেষ যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে পাকিস্তানিরা পরাজিত হলে পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয় ফরিদপুর। এরপর আমরা নিজেদের অস্ত্র জমা দিই বায়তুল আমান ক্যাম্পে। স্বাধীন বাংলাদেশে আবার আমি ফিরে যাই আমার কলেজে।’
যুদ্ধদিনের কথা বলতে গিয়ে আমিনুর রহমান ফরিদ তাদের সতীর্থদের কথা বারবার স্মরণ করেন। তাঁদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস যেন তরুণ প্রজন্ম জানতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে—সেই আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ উন্নতির দিকে যাবে, এমনটাই বিশ্বাস করেন তিনি।