১১ বছরেই বার্ধক্যে নিতু!
ছবির মেয়েটির নাম নিতু আক্তার। তার মুখাবয়ব, চুলহীন মাথা আর কুচকানো গায়ের চামড়া দেখে অনেকেই ওকে ষাটোর্ধ্ব মানুষ বলে ভাবেন। কিন্তু অবিশ্বাস্য সত্য হলো, নিতুর বয়স কেবল ১১ বছর!
ভয়ানক রোগ প্রজেরিয়া নিতুর শৈশব কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে ওর আয়ুও। চিকিৎসকরা বলছেন, নিতু হয়তো বাঁচবে আর মাত্র দুই বছর। কেননা, চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী, এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের গড় আয়ু মাত্র ১৩ বছর।
মেয়ে বাঁচবে না জেনেও থেমে নেই নিতুর বাবা-মা। করে যাচ্ছেন প্রাণান্তর চেষ্টা।
হবিগঞ্জ শহরের শায়েস্তানগর এলাকার বাসিন্দা ওয়ার্কশপের কর্মচারী কামরুল হাসান কমরু ও স্ত্রী জোৎস্না বেগমের ঘরে ২০০৭ সালে নিতুর জন্ম হয়। জন্মের তিন মাস পর নিতু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। শুকিয়ে আসতে থাকে নিতুর হাত, পা, মুখ, শরীরের চামড়া। ফুটফুটে চেহারা হয়ে ওঠে বৃদ্ধদের মতো। পরে হবিগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে চিকিৎসা করান নিতুর মা-বাবা। কিন্তু কোনো সমাধান না পেয়ে নিতুর মা-বাবা সিলেটে দুই বছর মেয়ের চিকিৎসা করান। এতেও কোনো ফল পাননি তাঁরা।
এর কয়েকদিন পরপর অসুস্থ হয়ে পড়ে নিতু। দিশেহারা হয়ে পড়েন মা-বাবা। একপর্যায়ে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) নিতুর চিকিৎসা শুরু করেন। সেখানে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নিতুর চিকিৎসা করানো হয়।
অনেক গবেষণা করে চিকিৎসকরা ওই মা ও বাবাকে জানান, নিতু প্রজেরিয়া রোগে আক্রান্ত। এ ধরনের রোগীরা অধিকাংশ সময় অসুস্থ থাকেন। চিকিৎসা করে এর কোনো ফলাফল পাওয়া যায় না।
গত বছর বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে নিতু। এ সময় নিতু খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। তরল খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। এ সময় চিকিৎসকদের কাছে নিলে তাকে আটটি ইনজেকশন দেওয়া হয়। কিন্তু নিতুর শরীর শুকিয়ে গিয়ে মাংস শক্ত হয়ে যাওয়ায় ইনজেকশন দেওয়ার সময় সূঁচ ভেঙে যায়। এ সময় টানা ছয় মাস অসুস্থ থাকে নিতু।
এদিকে, মেয়ের চিকিৎসা করতে গিয়ে জায়গা-জমি বিক্রি করে অনেকটা নিঃস্ব হয়ে গেছেন বাবা কামরুল হাসান কমরু। এরই মধ্যে শারীরিক নানা জটিলতায় ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট এ শিশুটি। তাঁর ছয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান নিতু।
এ ব্যাপারে নিতুর বাবা কামরুল হাসান ও মা জোৎস্না বেগম বলেন, নিতুর চিকিৎসা করতে করতে সব কিছু বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এ ধরনের রোগীরা বেশি দিন বাঁচে না। চিকিৎসা করিয়ে কোনো লাভ হবে না। তারপরও তারা নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে চিকিৎসা করে যাচ্ছেন।
নিতু তাসনুভা-শামীম ফাউন্ডেশনের প্রতিবন্ধী স্কুলে লেখাপড়া করছে। সে লেখাপড়ায় ভালো। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানান, পড়াশুনার পাশাপাশি খুব ভালো ছবি আঁকে নিতু।
সমাজকর্মী চৌধুরী জান্নাত রাখীর সন্তানদের সঙ্গে প্রজেরিয়া রোগে আক্রান্ত নিতু আক্তার (মধ্যে)। ছবি : এনটিভি
কিছুদিন আগে হবিগঞ্জের সমাজকর্মী চৌধুরী জান্নাত রাখীর সঙ্গে পরিচয় হলে রাখী নিতুকে নিজের সন্তানের মতো দেখাশোনা শুরু করেন তিনি। এখন নিতুর অধিকাংশ সময় কাটে রাখীর বাসায়, তার সন্তানদের সঙ্গে খেলা করে। রাখীর ছেলেমেয়েরাও নিতুকে আপন করে নিয়েছে বোনের মতো।
বাংলাদেশ মাদকবিরোধী শক্তি কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী জান্নাত রাখী বলেন, ‘কিছুদিন আগে নিতুর সাথে আমার পরিচয় হয়। সবার কাছে নিতুকে দেখতে হয়তো অস্বাভাবিক লাগে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে পুতুলের মতো। এরপর মেয়েটিকে আমার অনেক ভালো লেগেছে। ওর সাথে আমার নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ হয়। নিতুও আমাকে ভালোবাসতে শুরু করে। আমার সন্তানরাও তাকে ভালোবাসে এবং তার সাথে খেলাধুলা করে। আমি নিতুকে আমার সন্তানদের সাথে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে নিয়েছি।’
রাখী বলেন, নিতুদের কখনও অবহেলা করতে নেই। তাদের সাথে স্বাভাবিক বাচ্চাদের মিশতে দিতে হবে। নিতু অটিজম নয়, তার জ্ঞান বুদ্ধি ও মেধা স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো।
সরকারি কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে নিতুর বাবা কামরুল হাসান জানান, গত বছর হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউছ ১০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছেন। আর প্রতি মাসে প্রতিবন্ধী ভাতা ৭০০ টাকা করে পাচ্ছেন।
কিন্তু এই সাহায্য দিয়ে বিরল এই রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে তাদের জন্যে। এ পরিস্থিতিতে নিতুর পাশে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, জেলা প্রশাসনসহ সমাজকর্মীরা।
প্রজেরিয়ায় আক্রান্ত নিতু আক্তারের হাতে সহায়তার টাকা তুলে দিচ্ছেন এমপি অ্যাডভোকেট আবু জাহির। ছবি : এনটিভি
আজ মঙ্গলবার সকালে হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) মো. আবু জাহির ও জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ শায়েস্তানগরে নিতুদের বাসায় যান। তাঁরা উভয়েই নিতুকে ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেন।
এ সময় এমপি আবু জাহির প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নিতুর পরিবারের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার আশ্বাস দেন। জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরো সহায়তা দেওয়ার কথা জানান।
নিতুর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ ফয়জুল হক বলেন, ‘নিতুকে নিয়ে আমাদের স্কুলে যাত্রা শুরু হয়েছিল। নিতু অনেক ভালো ছাত্রী। সে অসুস্থ থাকার কারণে নিয়মিত স্কুলে আসতে পারে না। তবে নিতুর পড়ালেখার পাশাপাশি ছবি আঁকায়ও আগ্রহ রয়েছে। তাঁর কর্মকাণ্ডে আমরা শিক্ষকরা খুশি।’
হবিগঞ্জ জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক হাবিবুর রহমান জানান, নিতুকে তিনি দেখেছেন। তাকে বর্তমানে ৭০০ টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে তাকে কোনো বড় সহযোগিতা করা যায় কি না সেটি ভাবছেন বলেও তিনি জানান।
নিতু প্রসঙ্গে হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মো. আবু সুফিয়ান বলেন, ‘আমাদের বয়স হলে যেমন শরীরের কাঠামো তৈরি হয়, নিতুর শরীরের সে ধরনের কাঠামো তৈরি হয়েছে। আমরা একজন বুড়ো মানুষকে যেভাবে যত্ন নেই, তাদেরকে সে ধরনের যত্ন নিতে হবে। এসব বাচ্চারা বেশিদিন বাঁচে না। তাদের গড় আয়ু হলো ১৩ বছর। তাদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। এতে যতদিন তারা বেঁচে থাকবে জীবনটা ভালো কাটাতে পারবে। তবে এ রোগের কোনো চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই।’