সাংবাদিকতার ধরন পাল্টে দিয়েছে ইউটিউব
২০০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পেপ্যালের সাবেক তিন কর্মী চাদ হার্লে, স্টিভ চেন এবং জায়েদ করিম একটি নতুন ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠানের নাম নিবন্ধন করেন। তাদের চিন্তাভাবনা ছিল খুবই সাধারণ- এমন একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা যেখানে মানুষ ভিডিও আপলোড করতে পারবে এবং অন্যদের আপলোড করা ভিডিও দেখতে পারবে। সেই সময়ে এই সাধারণ একটি চিন্তাই ছিল অনেক উচ্চাভিলাষী।
ইন্টারনেটে একটি ভিডিও খুঁজতে গিয়ে অকূল পাথারে পড়েছিলেন ইউটিউবের উদ্যোক্তাদের একজন, জায়েদ করিম। ২০০৪ সালের ভারত সাগরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুনামির একটি ভিডিও খুঁজছিলেন করিম। কোথাও কিছু না পেয়ে ভিডিও দেখার একটি ওয়েবসাইট তৈরির বুদ্ধি তার মাথায় আসে।
চালু হওয়ার দুই মাসের ভেতরও ইউটিউবে কেউ কোনো ভিডিও আপলোড করেনি। কারণ কারো কোনো আগ্রহও ছিল না সাইটটি নিয়ে। এপ্রিলের ২৩ তারিখে করিম নিজেই একটি ১৯ সেকেন্ডের ভিডিও আপলোড করেন। সান দিয়েগো চিড়িয়াখানায় হাতির খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে করিম বলেছিলেন, ‘হাতিগুলো সত্যিই অনেক অনেক বড়। এটা অনেক মজার একটা বিষয়।’
এই ভিডিওটা অস্কার পাওয়ার মতো ছিল না অবশ্যই। কিন্তু ইউটিউবের প্রথম ভিডিও হিসেবে এটি ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও। আপলোডের পর থেকে এখন পর্যন্ত ভিডিওটি ইউটিউবে মোট এক কোটি ৭৫ লাখ বার দেখা হয়েছে।
আজকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভিজিডেট ওয়েবসাইটের মধ্যে ইউটিউবের অবস্থান তৃতীয়। ব্যবহারকারী রয়েছে ১০ লাখেরও বেশি। প্রতি মাসে এসব ব্যবহারকারী ৬০০ কোটি ঘণ্টার ভিডিও ইউটিউবে দেখে থাকেন। ইউটিউবের সার্ভারে প্রতি মিনিটে ৩০০ ঘণ্টার ভিডিও আপলোড করেন ব্যবহারকারীরা।
সাইটকে জনপ্রিয় করার জন্য আজেবাজে ভিডিও আপলোড করা হয় বলে যে দুর্নাম ইউটিউবের রয়েছে, তা এর পরিসংখ্যান দেখলে ভুল মনে হবে। কারণ ইউটিউবের সবচেয়ে বেশি দেখা ৩০টি ভিডিওর মধ্যে ২৯টি হচ্ছে পেশাদার নির্মাতাদের তৈরি করা জনপ্রিয় মিউজিক ভিডিও। সে হিসেবে ইউটিউবকে এই প্রজন্মের গানের চ্যানেল বলা যেতে পারে।
২০০৬ সালে দেড়শো কোটি ডলারে ইউটিউব কিনে নেয় গুগল । তত দিনে ইউটিউব জনপ্রিয় বিনোদন মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে ইউটিউবের বাজার মূল্য চার হাজার কোটি ডলার। কিন্তু এর বাইরেও দুনিয়াজুড়ে খবর তৈরি এবং সম্প্রচারের ধরন পাল্টে দিয়েছে ইউটিউব।
একসময় সুনামির ভিডিও পুরো ইন্টারনেট খুঁজেও পাননি ইউটিউবের সহ প্রতিষ্ঠাতা জায়েদ করিম। আর ইউটিউব প্রতিষ্ঠার ছয় বছর পর ২০১১ সালে জাপানের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুনামির ভিডিও দেখা হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি বার।
একই বছর পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় বলা হয়, বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমে যেসব ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে তার ৩৯ শতাংশ ফুটেজই তুলেছে সাধারণ মানুষ। আনকোরা হাতে তোলা এসব ভিডিও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোকে অনেক বিপদসংকুল এলাকার খবর জানিয়েছে। বিশেষ করে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের যেসব ভিডিও ফুটেজ সম্প্রচার করা হয়েছে তার বেশির ভাগই সাধারণ মানুষের তোলা।
এ ছাড়া বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রচারেই ইউটিউব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ইরানের তরুণ বিক্ষোভকারী নেদা সোলতানের মৃত্যুর দৃশ্য আপলোড করা হয়েছিল ইউটিউবে। আর তারপর তা ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে ওই ভিডিওর কারণে ইরানে বড় ধরনের সরকারবিরোধী বিপ্লব হয়েছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে দুনিয়ায় ত্রাস সৃষ্টি করেছে ইসলামিক স্টেট নামের একটি জঙ্গি সংগঠন। জঙ্গিরা তাদের কর্মকাণ্ড এবং প্রোপাগাণ্ডা ছাড়ানোর জন্য ব্যবহার করেছে ইউটিউবকে। অতি সম্প্রতি আইএস জঙ্গিরা তাদের হাতে বন্দি থাকা জর্ডানের এক পাইলট মুয়াদ আল কাসাবেহকে খাঁচায় বন্দি করে পুড়িয়ে মেরেছিল।
এই ভিডিওটি জর্ডানে ব্যাপক বিক্ষোভের সঞ্চার করে। এর জবাবে জর্ডান সরকার প্রতিশ্রুতি দেয় তারা আইএসের এই নিষ্ঠুরতার কঠোর জবাব দেবে। অনলাইনে আপলোড করা এসব ভিডিও জঙ্গিদের নিজেদের খবর প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমে হিসেবে কাজ করেছে।
দি আটলান্টিকের প্রতিবেদক জেফ্রে গোল্ডবার্গ লিখেছেন, ‘খবর প্রচারের জন্য উগ্রবাদীদের এখন আর কারো সাহায্যের দরকার নেই। সাংবাদিকদের জায়গাটা এখন ইউটিউব নিয়ে নিয়েছে।’
ইউটিউব, ফেসবুক ও টুইটারের এই যে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা তা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের খবর জানতে মানুষকে সাহায্য করছে। বেরিয়ে আসছে সমস্যার সমাধান। ইউটিউবের বিভিন্ন ভিডিও দেখে এখন মানুষ কোনো ঘটনার পক্ষ এবং বিপক্ষ উভয়ের বক্তব্যই স্পষ্টভাবে জানতে পারছে আলাদা করে।
২০০৯ সালে কোনো ছাড় না দিয়েই বিক্ষোভকারীদের দমাতে পেরেছিল ইরান সরকার। কিন্তু আরব বসন্তের ধাক্কায় মিসর, ইয়েমেন, সিরিয়া ও লিবিয়াতে ক্ষমতাসীনদের পতন ঘটেছে। ইরান ও চীনে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইউটিউব।
ইউটিউবের স্লোগানে বলা হয়েছে, ‘নিজেকে সম্প্রচার করো।’ আর এই প্রক্রিয়াটাই সাংবাদিকতার ধরনকে পাল্টে দিয়েছে। এখন ইন্টারনেট সংযোগসহ কোনো স্মার্টফোন হাতে থাকলে আপনিও হয়ে উঠতে পারেন সংবাদদাতা। আপনাকে আর তখন ঘটনা জানার জন্য টিভির পর্দায় চোখ রাখতে হবে না। এটাই মনে হয় ইউটিউবের সবচেয়ে বড় সাফল্য, যারা একটি হাতির মাত্র ১৯ সেকেন্ডের ভিডিও দেখিয়ে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল।