জামায়াত নেতা সুবহানের মামলার রায় কাল
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুহাম্মদ আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে করা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আগামীকাল বুধবার। আজ মঙ্গলবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ রায় ঘোষণার এই দিন ঠিক করেন।
গত বছরের ৪ ডিসেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছিলেন ট্রাইব্যুনাল।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত বলেন, প্রতিটি অভিযোগ তাঁরা প্রমাণ করতে পেরেছেন। তাঁরা সুবহানের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করছেন।
তবে আসামিপক্ষ দাবি করছে, সুবহানের বিরুদ্ধে আনা নয়টি অভিযোগের একটিও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা যায়নি। তাই তিনি বেকসুর খালাস পাবেন বলে আশাবাদী তারা।
ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রসিকিউশন এই মামলায় সর্বমোট নয়টি অভিযোগ এনেছে এবং ৩১ জন সাক্ষী উপস্থাপন করেছে। এই ৩১ জন সাক্ষীর বক্তব্যের মধ্যে পারস্পরিক যে বিপরীতধর্মী বক্তব্য রয়েছে এবং অসামাঞ্জস্যতা রয়েছে এগুলো আমরা ট্রাইব্যুনালের সামনে তুলে ধরেছি। আমরা মনে করি, এই নয়টি অভিযোগের একটিও সুবহান সাহেবের বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি।’
সাফাই সাক্ষী উপস্থাপন প্রসঙ্গে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে এ আইনজীবী বলেন, ‘আমরা একজন সাক্ষী উপস্থাপন করেছি। এই সাক্ষীর কাজ ছিল তিনি ডকুমেন্টগুলো এক্সিবিট করেছেন। আমাদের সাক্ষীর মাধ্যমে আমরা আমাদের ঘটনাগুলো উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। আমরা মনে করি, সার্বিক বিবেচনায় ট্রাইব্যুনাল মাওলানা সুবহান সাহেবকে মামলার প্রত্যেকটি অভিযোগ থেকে খালাস প্রদান করবেন এবং আমরা ন্যায়বিচার পাব।’
এ প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর/রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে নয়টি অভিযোগ তাঁর (সুবহান) বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল। এ অভিযোগের মধ্যে আছে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন এবং অগ্নিসংযোগসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে ঈশ্বরদী কয়লার ডিপোতে নিয়ে নিজ হাতে তলোয়ার দিয়ে উনি ৪০ জন মানুষকে জবাই করেছেন। এমন আরো আটটি ঘটনা আমরা প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে অভিযোগ হিসেবে উত্থাপন করেছি। দুজন তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ মোট ৩১ জন সাক্ষী দেওয়া হয়েছিল প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে। এই সাক্ষীদের মধ্যে ভিকটিমও রয়েছেন।’
অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছেন কি না তা জানতে চাইলে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘আমরা সন্দেহাতীতভাবে আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হয়েছি।’
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ নয়টি অপরাধের অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সুবহানের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। সেদিন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর জন্য ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি দিন নির্ধারণ করেন।
মামলা চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৩১ সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। আর আসামিপক্ষ হাজির করে একজন সাফাই সাক্ষী।
এর আগে ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধুর সেতুর পূর্ব পাশ থেকে আবদুস সুবহানকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর জামিন চেয়ে আবেদন করেন জামায়াতের এই নেতা। তবে ২ অক্টোবর জামিন আবেদন খারিজ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়। একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর সুবহানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ২ অক্টোবর থেকে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি শুরু হয়।
শুরুতে আবদুস সুবহানের মামলা ট্রাইব্যুনাল ১-এ বিচারাধীন থাকলেও ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এটিকে ট্রাইব্যুনাল ২-এ স্থানান্তর করেন ট্রাইব্যুনাল ১-এর বিচারক।
অভিযোগ রয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তায় পাবনা জেলায় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শুরু করেন আবদুস সুবহান। তিনি পাবনা জেলা জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আমির ও কেন্দ্রীয় জামায়াতের শুরা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। পরে পাবনা পিস কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন।
আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের অভিযোগ গঠন করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঈশ্বরদী জামে মসজিদে আশ্রয় নেওয়া স্বাধীনতাকামী মানুষকে বিহারিদের সহায়তায় হত্যা করা, ১৩ এপ্রিল ঈশ্বরদীর যুক্তিতলা গ্রামে লুটপাট ও পাঁচজনকে হত্যায় নেতৃত্ব দেওয়া, ২ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নিয়ে সাহাপুর গ্রামে বাড়িঘর লুটপাট ও কয়েকজনকে হত্যা, ১২ মে সুজানগরের কয়েকটি গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তিন-চারশ মানুষকে হত্যা।