কূটনীতিকদের সামাজিক যোগাযোগ
১৮৪০ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড পালমার্সটন জীবনের প্রথম টেলিগ্রাম পাওয়ার পর বলেছিলেন, ‘এটাই কূটনীতির সমাপ্তি’। সেখান থেকে পেরিয়ে গেছে ১৭০ বছর। আজকের দুনিয়ায় যখন ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনেহেগেনের একটি ক্যাফের জানালা বুলেটবিদ্ধ হয়, তখন ডেনমার্কে নিয়োজিত ফরাসি রাষ্ট্রদূত ফ্রাঁসোয়া জিমরে টুইট করেন, ‘এখনো বেঁচে আছি।’
পালমার্সটনের আশঙ্কা সত্যি হয়নি। কূটনীতি এখনো বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। তবে এর ধরন পাল্টেছে নিঃসন্দেহে। মানুষ এখন কূটনীতিকদের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে বা বলা যায় কূটনীতিকরাই সাধারণ মানুষের কাতারে নেমে এসেছেন।
ফরাসি রাষ্ট্রদূত জিমেরের ম্যাসেজটি দুই হাজারবারেরও বেশি রিটুইট হয়েছে। সেই টুইটটি ছিল অনেকের কাছে ‘ব্রেকিং নিউজ’। এর মাধ্যমেই হামলার ঘটনাটি জানতে পারে তারা। সেই হামলায় দুজন মানুষ মারা গিয়েছিল।
মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে খবর জানতে পারলেও জিমেরের টুইট নিয়ে সমালোচনা করেছেন অন্য কূটনীতিকরা। তাঁদের মতে, এর মাধ্যমে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সাবেক ব্রিটিশ কূটনীতিক এবং বর্তমানে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক গোর্দেন বারাস বলেছেন, ‘টুইটগুলো তো সন্ত্রাসীরাও নিয়মিত দেখছে। তাহলে তথ্যগুলো তো তারাও পেয়ে যাচ্ছে সাথে সাথে। টুইটার ব্যবহার কূটনীতিকদের জন্য পিচ্ছিল পথে হেঁটে যাওয়ার মতো। সাবধানে না হাঁটলে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ।’
জিমেরের টুইটের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি ডেনমার্কের ফরাসি দূতাবাস। এমনকি জিমেরের বক্তব্য নেওয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়নি।
তবে ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘ফরাসি কূটনীতিকরা যখন নিজেদের নামে টুইট করেন তখন তাঁরা মন্ত্রণালয়ের সম্পাদকীয় নীতি মেনেই তা করেন। তবে সেখানে তাঁদের ব্যক্তিগত আবেগটাই বেশি ফুটে ওঠে।’
জিমেরে যেই পরিস্থিতিতে টুইট করে হামলার কথা জানিয়েছেন, তাতে এটা বোঝা গেছে যে কূটনীতিকরা যতই কথার খেলা খেলুক না কেন, দিনশেষে তাঁরাও মানুষ। তাঁরাও সাধারণ মানুষের মতো করে ভাবেন।
রাশিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা মাইকেল ম্যাকফল বলেন, ‘কূটনৈতিক বিষয়গুলো কখনোই গোপন থাকা উচিত নয় এবং টুইটারের মাধ্যমে কূটনীতিকরা তাদের নিজস্ব মতামত জানাতে পারছেন।’
কূটনীতিকরা কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বিশেষ করে টুইটারে বেশ সক্রিয়। অনেক খবরই তাঁরা জানান টুইটের মাধ্যমে। গত বছর লাটভিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী টুইটের মাধ্যমে জানিয়েছিলেন, তিনি একজন সমকামী। লোকসভা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পর সাথে সাথে সেটা ছবিসহ টুইট করে জানিয়েছিলেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। টুইটারে মুখ খোলার বিপদও রয়েছে। যেমন গত বছর টুইটারে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সমালোচনা করায় তিন কূটনীতিককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।
গত কয়েক বছরে টুইটারে রাষ্ট্রদূত, দূতাবাস, কূটনীতিকদের উপস্থিতি এতটাই সরব যে কূটনীতিতে এখন ‘টুইপ্লোমেসি’ নামের একটা শব্দ চালু হয়ে গেছে।
গণযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান বুর্সন-মার্সেটলারের দেওয়া তথ্যমতে, টুইটারে সাড়ে তিন হাজারের বেশি কূটনীতিক, দূতাবাস এবং রাষ্ট্রদূতের অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ২০১৩ সাল থেকেই সুইডেনের সব দূতাবাসের ফেসবুক এবং টুইটার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এমনকি উত্তর কোরিয়া যেখানে ইন্টারনেট ব্যবহার বেশ কষ্টসাধ্য, সেখানকার সুইডিশ দূতাবাসের অ্যাকাউন্টও সচল।
গত বছরের আগস্টে তো রীতিমতো ইউরোপের মানচিত্র নিয়ে হাঙ্গামা শুরু হয়ে গিয়েছিল টুইটারে। ঘটনার সূত্রপাত করেন ন্যাটোর কানাডিয়ান একটি প্রতিনিধিদল। তাঁরা টুইটারে ইউরোপের একটি মানচিত্র প্রকাশ করেন, যেখানে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ দেখানো হয়। অথচ ততদিনে ক্রিমিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার সাথে যোগ দিয়েছে।
একদিন পরেই টুইটারে এর পাল্টা জবাব দেয় ন্যাটোতে থাকা রাশিয়ার প্রতিনিধিদল। তাঁরা আরেকটি মানচিত্র প্রকাশ করেন, যেখানে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ দেখানো হয়। কানাডিয়ান বন্ধুদের ইউরোপের মানচিত্রটা ঠিকমতো বোঝারও পরামর্শ দেওয়া হয় সেই টুইটে।
২০০৬ সালে চালু হয়েছিল টুইটার। নয় বছর পরে বিশ্বজুড়ে টুইটার ব্যবহার করছেন ৩০০ কোটি মানুষ। কূটনীতিকরাও এর বাইরে নন। কূটনীতিকে টুইটারের অংশ করে নেওয়ার জন্য সচেষ্ট টুইটার কর্তৃপক্ষ। এর জন্য টুইটারের রয়েছে আলাদা শাখা ‘গভর্নমেন্ট ডিভিশন’। এই শাখার প্রধান অ্যাডাম শার্প জানিয়েছেন, ‘বিশ্বজুড়ে কূটনীতিকদের মধ্যে যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি করার জন্য টুইটারকে তৈরি করা হচ্ছে।’