প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা করবেন যেভাবে
বলা হয়, প্রবীণ বয়সে মানুষ শিশুর মতো হয়ে যায়। কথাটি অনেকাংশেই সঠিক। একজন প্রবীণ মানুষের যত্ন সেভাবেই নিতে হয়, যেভাবে একটি শিশুর যত্ন নেওয়া হয়। প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবার এই বিষয়টিকে বলা হয় জেরিয়াট্রিক হেলথকেয়ার।
জেরিয়াট্রিক হেলথকেয়ারের বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩১৯৪তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক সরদার এ নাঈম। বর্তমানে তিনি জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও ল্যাপারোস্কোপি সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত। তিনি পূর্বাচলে নির্মাণাধীন এভারগ্রিন রিটায়ারমেন্ট হোমসের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।
প্রশ্ন : জেরিয়াট্রিক মানে কী? স্বাস্থ্যসেবা কেন তাদের দরকার?
উত্তর : ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এটি। আমি এনটিভিকে ধন্যবাদ জানাই, এই ধরনের বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলতে যাচ্ছি এই জন্য। জেরিয়াট্রিক শব্দটিই আমরা ব্যবহার করি বৃদ্ধদের যেকোনো কিছুর ব্যাপারে। যেমন জেরিয়াট্রিক মেডিসিন বা জেরিয়াট্রিক হেলথকেয়ার। জেরিয়াট্রিক ফেসিলিটিস, জেরিয়াট্রিক নার্সিং, জেরিয়াট্রিক কেয়ার গিভার ট্রেনিং। এগুলোর সবটাই একটি নির্দিষ্ট দলের জন্য। যাঁরা প্রবীণ তাঁদের জন্য।
জেরিয়াট্রিক জনগণকে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমাদের দেশে সম্ভবত ৬৫ এবং তার ওপরের বয়সের লোকদের আমরা সিনিয়র সিটিজেন বলি। তবে জেরিয়াট্রিক শব্দটা আমরা ব্যবহার করতে চাই, তাদের জন্য যাদের আরো বেশি বয়স। যেমন ৭০ বা ৭৫ প্লাস যাঁরা হয়ে গেছেন। তাঁদের কিন্তু জীবন ধারণের জন্য একটু বিশেষ যত্ন লাগে। সেই জেরিয়াট্রিক হেলথকেয়ার, আমরা যদি বলি একজন মানুষ, একজন ৮০ বছরের বৃদ্ধ, উনি বসে রয়েছেন, কোথায় ধরে তাঁকে দাড় করাতে হবে এর জন্যও বিশেষ প্রশিক্ষণ লাগে। জেরিয়াট্রিক সুবিধা যদি আমরা তৈরি না করতে পারি, তাহলে এই ধরনের প্রশিক্ষণের সুবিধাও তৈরি হবে না। আমি মনে করি বাংলাদেশে এখন সময় এসেছে এই জেরিয়াট্রিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চিন্তা করার।
আমরা পেডিয়াট্রিকের সঙ্গে প্রথম থেকেই পরিচিত। তবে জেরিয়াট্রিক শব্দটার সঙ্গেই পরিচিত নই। এই দেশে অনেক শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও এই শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়। চিকিৎসকরা হয়তো জানেন, কারণ চিকিৎসা বিদ্যায় পড়ে এসেছেন বলে।
আমি জাপানে পড়াশোনা করেছি। জাপান চার নম্বর এই দিকে। জাপানে গড় বয়স প্রায় নব্বইয়ের বেশি। সুতরাং ৭০ বছর বয়সের বেশি যাঁদের তাঁদের কিন্তু বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন সহযোগিতা লাগে। কেউ হয়তো নিজে হাঁটাচলা করতে পারে। তবে তার কিছু বিশেষ যত্ন লাগে। হাঁটাচলা করা অবস্থায় কিন্তু কেউ কেউ ডিমেনসিয়ার (স্মৃতিভ্রম) রোগী থাকেন, কেউ আলঝেইমারের রোগী থাকেন। এই যে স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে, এদের কিন্তু বিশেষ যত্ন লাগে। আমাদের সমাজে কিন্তু অনেক আমি দেখতে পাই।
আমাদের সমাজে সাধারণের মধ্যে তো রয়েছে, এমনকি উচ্চবিত্তদের মধ্যেও বিষয়টি রয়েছে, একটি নির্দিষ্ট বয়সের মানুষরা যে কী অসহায় জীবন যাপন করছে, সেটি আমরা খোঁজ নিলেই জানতে পারব।
প্রশ্ন : বৃদ্ধাশ্রমের বিষয়টি চলে আসে। এটি কিন্তু আমাদের সমাজে একটি নেতিবাচক বিষয় নিয়ে এসেছে। এই বিষয়ে আপনার মতামত কী?
উত্তর : আসলেই। আমি সম্মত আপনার কথার সঙ্গে। আমি মনে করি বৃদ্ধদের জন্য যে স্বাস্থ্যসেবা বা বসবাসের জায়গা প্রস্তুত করা সেটা ঠিক বৃদ্ধাশ্রমের সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে হবে না।
আমি যেমন নিজেই একটি রিটায়ারমেন্ট হোমের কাজে হাত দিয়েছি। আমার সার্জারি জীবনের পরে জীবনের শেষ পর্যন্ত এই কাজটি করতে চাই।
যেই প্রজেক্টটি আমরা করছি সেটি হলো জেরিয়াট্রিক হোম, জেরিয়াট্রিক হসপিটাল, জেরিয়াট্রিক নার্সিং স্কুল, জেরিয়াট্রিক কেয়ার গিভার ট্রেনিং স্কুল। একটি কমপ্রিহেনসিভ সম্পূর্ণ জেরিয়াট্রিক প্রোজেক্ট।
আমরা কিন্তু খুব সহজে বলি বৃদ্ধরা বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়। কিন্তু একটি বাচ্চার যদি ডায়াপার পরিবর্তন করতে হয়, আমরা মা-বাবা হিসেবে দেখেছি, এটা আনন্দের ব্যাপার। আমাদের কাছে কষ্ট লাগে না। কিন্তু একজন বৃদ্ধ মানুষ বা মা-বাবার ডায়াপার পরিবর্তন করা ভিন্ন বিষয়। যিনি একদম বৃদ্ধ মানুষ, বিছানাতেই প্রস্রাব- পায়খানা করছে, তার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ লাগবে। সেটা কিন্তু পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে সবাইকেই নিতে হতে পারে। সেই প্রশিক্ষণ ছাড়া কিন্তু একজন বৃদ্ধকে সে সহযোগিতা দেওয়া যাবে না। আমরা যেটি মনে করি, এ ধরনের রিটায়ারমেন্ট হোম বা জেরিয়াট্রিক হোমগুলোর যদি আমরা সেই সুবিধা তৈরি করি, তাহলে আমাদের দেশে, যদি ঢাকা শহরই চিন্তা করি, তাহলে ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা, এসব জায়গায় হাজার হাজার দম্পতি রয়েছে, তারা আসলে বাস করছে বুয়া ও দারোয়ানদের দয়ায়। দারোয়ানরা বাজার করে দিলে বাজার হয়, বুয়ারা রান্না করে দিলে রান্না হয়। কারণ, তাদের বাজারে যাওয়া সম্ভব হয় না।
আমরা তাই দেখতে পাই না। আমাদের কিন্তু মনে থাকে না ৭০/ ৮০/৯০ বছরের কত মানুষ ঘরের কুঠরিতে। হয়তো তারা খুব ধনী। তবে অনেক টাকা থাকা সত্ত্বেও তারা এই সুবিধা পাচ্ছে না।
আমাদের বন্ধুবান্ধবরা আমাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে যোগাযোগ করে বলে আমাকে দুটো নার্স দাও, এটা দাও, ওটা দাও, আমার মা-বাবার যত্ন করার জন্য। কিন্তু আমরা ইনস্টিটিউশন হিসেবে এখনো তৈরি করতে পারিনি বলেই আমি নিজেকে এই জেরিয়াট্রিক ফেসিলিটিসে যুক্ত করছি।
প্রশ্ন : জেরিয়াট্রিক হেলথকেয়ারের মধ্যে কোন বিষয়গুলো যুক্ত করেছেন?
উত্তর : বৃদ্ধ মানুষের কিছু আলাদা সমস্যা তৈরি হয়। ধরুন, প্রবীণদের ত্বকের সমস্যা। বৃদ্ধ মানুষের কিন্তু কতগুলো আলাদা ত্বকের সমস্যা তৈরি হয়। কার্ডিয়াক বলেন, রেনাল বলেন, যারা শয্যাশায়ী হয়ে যায়, যাদের স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যায়- তাদের কিন্তু অসুবিধা।
আমাদের খুব কষ্ট লাগে বলতে জীবনে একটি পর্যায়ে কিন্তু মানুষ হাঁটাচলায়ও সহায়তা লাগে এমন জীবনে চলে যায়, এরপর শয্যাসায়ী হয়, এরপর আস্তে আস্তে কবরে চলে যেতে হয়। একে আসলে পুরোপুরি এড়ানো যাবে না। কিন্তু এই দিনগুলোর কথা মনে থাকে না বলে আমরা এই জায়গায় অনেক পরে এসেছি।
তিনটি জিনিসের কথা আমাদের মনে থাকে না। আমি অনেককেই এই কথা বলি। অসুস্থতার কথা মনে থাকে না, বার্ধক্যের কথা মনে থাকে না এবং মৃত্যুর কথা মনে থাকে না। এই তিনটি জিনিসের কথা মনে থাকে না বলেই হয়তো আমরা এগিয়ে যেতে পারি।
প্রশ্ন : অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, বৃদ্ধাশ্রম নিম্ন বিত্তদের জন্য, আর এটা উচ্চ বিত্তদের জন্য। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
উত্তর : আমরা জেরিয়াট্রিক কেয়ারটি একটি এফোর্টেবল বা যারা ব্যয়ভার বহন করতে পারবে এমন জনগোষ্ঠীর জন্য এই মুর্হূতে শুরু করেছি। এর মানে এই নয় যে এটি দরিদ্রদের জন্য নয়। কিছু কিছু বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে, লঙ্গরখানার মতো। যাদের কেউ নেই তাদের এমন করেও যদি রাখা হয় আমি তাদের স্যালুট করি। তবে আমি যেটি চাচ্ছি, একটি কমপ্রিহেনসিভ জেরিয়াট্রিক প্রোজেক্ট, যেখানে যেই জনগোষ্ঠীর সামর্থ রয়েছে, তারাও জীবনের শেষ সময়টুকু মনের মতো করে পার করতে পারবে। এখানে তার সন্তানদের থেকে তাকে আলাদা হতে হবে না। আমরা জেরিয়াট্রিক ডে কেয়ার সেন্টার রাখব।
আমি চাই না আমার মাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। সকালবেলা হোমের গাড়ি এসে তাকে নিয়ে যাবে। সারাদিন সে সুন্দর একটি পরিবেশে জীবন যাপন করবে, সন্ধ্যাবেলা আমি যখন বাড়ি ফিরব, হয় সেই প্রজেক্টের গাড়ি আমাকে নামিয়ে নিয়ে যাবে, অথবা আমার গাড়ি দিয়ে তাকে নিয়ে আসব।
একটি বয়সের পর বৃদ্ধ বয়সে এই যে নিয়মিত একজন মানুষকে ওষুধ খাওয়ানো, নিয়মিত তাকে চেকআপ করা, বাচ্চাদের মতো খেয়াল রাখা, এগুলো কঠিন।
প্রশ্ন : আপনারা যাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে কি সেই মানসিক প্রস্তুতি দিয়ে দিচ্ছেন?
উত্তর : অবশ্যই। কারণ, একজন বাচ্চার যত্ন নেওয়া যতটা সহজ, একজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার যত্ন নেওয়া তার তুলনায় শতগুণ কষ্টের। বৃদ্ধের ঘরের সামনে দিয়ে গেলে যেই দুর্গন্ধ আমরা পাব, একটি বাচ্চার ঘরে সেই দুর্গন্ধ থাকে না। সুতরাং এই দুর্গন্ধযুক্ত একটি মানুষের যত্ন অকাতরে করার পেছনে মানসিক প্রস্তুতি তৈরি করতে হয়। যেমন : অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে যদি কোলোনে কোনো আঘাত লাগে বা ফেটে যায়, ফাটা কোলনে যদি পায়খানা করে দেয় রোগী, তখন যে দুর্গন্ধ হয় ওটির মধ্যে সাধারণ মানুষ কিন্তু টিকতে পারবে না। কিন্তু আমি তো সেটি রেখে পালিয়ে যাই না। কারণ, আমার মানসিক প্রস্তুতি রয়েছে যে আমি তার সেবা করব। সুতরাং জেরিয়াট্রিক কেয়ার গিভার ট্রেনিং স্কুলের মাধ্যমে আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দেব। যেই শ্রেণিটা মেট্রিক পরীক্ষার পর ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত যেতে পারছে না, তাদের যদি আমরা এক বছর প্রশিক্ষণ দিয়ে সার্টিফিকেট দেই এবং তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয় যে এটা তোমার কাজ, তাহলে তারাও কিন্তু মনের আনন্দে জেরিয়াট্রিক কেয়ারে কাজ করবে।