ভারতে অনলাইন স্বাধীনতা এলো যে মেয়েটির জন্য
যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ওপর একটি কোর্স শেষ করে সবে দেশে ফিরেছেন শ্রেয়া সিংহল। ২০১২ সাল, সে সময় তাঁর বয়স মাত্র ২১। ভর্তি হয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে। হঠাৎ একদিন লক্ষ করলেন, রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে গ্রেপ্তার হতে হচ্ছে নেটিজেনদের (ইন্টারনেট ব্যবহারকারী)।
শিবসেনা-প্রধান বাল থ্যাকারের মৃত্যুর পর তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান উপলক্ষে মুম্বাই শহর কার্যত অচল হয়ে যাওয়া নিয়ে ফেসবুকে ‘আপত্তিকর স্ট্যাটাস’ দেওয়া ও তাতে লাইক দেওয়ার অপরাধে ২০১২ সালে শাহিন ধাদা ও রিনু শ্রীনিবাস নামের দুই নারী শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। শ্রেয়া ওই ‘আপত্তিকর পোস্টটি’ দেখছিলেন এবং যে আইনে ওই দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেটিও দেখছিলেন। ঘটনাটি তিনি কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না।
এ রকম আরো অন্তত ১০টি মামলার খোঁজ পাওয়া যায়, যেগুলোতে মন্ত্রী বা রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেওয়ার কারণে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। এসব গ্রেপ্তারের পেছনে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের একটি কালো ধারা। জনস্বার্থে এই আইনের বিরুদ্ধে পিটিশন করার সিদ্ধান্ত নেন শ্রেয়া।
গত ২৪ মার্চ অনলাইনে স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য বাধা হয়ে থাকা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ (এ) ধারা বাতিল করে দেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। আইনের এই অংশে কেউ অনলাইনে মন্তব্য করলে তাকে গ্রেপ্তার করার বিধান রাখা হয়েছিল। আর শ্রেয়া সিংহলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যুগান্তকরী এই রায় দেন আদালত। এই মামলাটি পরিচিতি পেয়েছে ‘শ্রেয়া সিংহল বনাম ভারত সরকার’ নামে।
পিটিশনটি দাখিল করার প্রেক্ষাপট নিয়ে হাফিংটন পোস্টকে শ্রেয়া বলেন, ‘একদিন রাতের খাবারের সময় টেবিলে বসেই আলোচনার মধ্যে বিষয়টি মাথায় আসে।’ শ্রেয়ার মা মানালি সিংহল একজন আইনজীবী। অন্য আইনজীবীদের সঙ্গেও আলোচনা হয়, এভাবে সব সময় সব আলোচনাই তর্কে রূপ নেয়, হাসতে হাসতে বললেন শ্রেয়া। একসময় শ্রেয়ার মনে হলো, এই আইনের কারণে যে কেউ গ্রেপ্তার হতে পারেন। তখন তাঁর মা বলেন, ‘যদি এ রকমই হয় তাহলে কেন তুমি এ বিষয়ে কিছু করছো না?’
এরপর আর দেরি করেননি শ্রেয়া। দু-তিনদিন পরই আরো কয়েকজন আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬(এ) ধারার বিরুদ্ধে পিটিশন দাখিল করেন তিনি। তবে কেউ যেন তাঁর এই কর্মকাণ্ডকে পারিবারিক বিষয় বলে উড়িয়ে দিতে না পারে, সে জন্য আবেদন করার সময় মায়ের সহায়তা নিলেন না। শ্রেয়ার পক্ষে আবেদনটি করেন আইনজীবী নিনাদ লাদ ও রঞ্জিতা রোহাতগি। এর প্রায় এক বছর পর শ্রেয়ার এই পিটিশনে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিনসহ আরো আটজন।
এখন ২৪ বছর বয়সী শ্রেয়া বললেন, ‘আমি অভিভূত। এটা আমার জন্য এক ধরনের শিক্ষা গ্রহণ।’ হাফিংটন পোস্টকে তিনি বলেন, ঘটনাটা যে এত ব্যাপকতা পাবে তা ধারণাই করতে পারেননি তিনি।
শ্রেয়া বলেন, পুরো প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে কঠিন বিষয় ছিল অপেক্ষা করা। কারণ রায় ঘোষণা করতে বেশি সময় না লাগলেও এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় আড়াই বছর। এই পুরো সময় শুধু পরিবার, বন্ধুদের সহায়তাই নয়, শ্রেয়া পেয়েছেন অপরিচিত মানুষদের সমর্থনও। ‘মনে হতো আমি শুধু গ্রেপ্তার হওয়া একজনের জন্য নয়, সবার জন্য কাজ করছি। আমাদের এই বিচিত্র দেশে যেখানে মত প্রকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা দরকার, সেখানেই আমাদের পরাধীন করে রাখা হয়।’ যোগ করেন তিনি।
রায় পাঠ করার সময় বিচারপতি আর এফ নারিমান বলেন, ‘আইনের এই অংশ অসাংবিধানিক এবং এটি বাতিল করে দিতে আমাদের কোনো দ্বিধা নেই।’ তিনি বলেন, ‘জনগণের জানার অধিকার এই আইনের ধারা ৬৬ (এর) দ্বারা সরাসরি খর্ব হয়।’ জনাকীর্ণ আদালত কক্ষে উপস্থিত ব্যক্তিরা সঙ্গে সঙ্গেই উল্লাস প্রকাশ করে রায়কে স্বাগত জানান।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের এই ধারা সম্পর্কে শ্রেয়া বলেন, ইন্টারনেটে কী দেখা যাবে বা কী থাকবে, তার সম্পর্কে আইনে স্পষ্ট কোনো ধারণাই দেওয়া ছিল না। শ্রেয়া বলেন, ৬৬(এ) ধারায় ইন্টারনেট সম্পর্কে যা বলা আছে, তাতে দোষী ব্যক্তি বুঝতেও পারবেন না যে তিনি কী অন্যায় করছেন আর কর্তৃপক্ষও তাঁর বিরুদ্ধে স্পষ্ট কোনো অভিযোগ আনতে পারবে না।
এখানে বলা আছে, আপত্তিকর বক্তব্য বা ভয়ভীতি প্রদর্শন করে কাউকে বিরক্ত বা সমস্যায় ফেলা হলে অভিযুক্তকে তিন বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। এখানে খারাপ বিষয় হলো, এসব কিছুকে কোনোভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যায় না। অথচ এটা ফৌজদারি আইনকে লঙ্ঘন করে। কেননা ফৌজদারি আইন অনুযায়ী প্রতিটি শব্দের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিতে হবে এবং ভুল বোঝাবুঝির কোনো সুযোগ রাখা যাবে না।
আদালত শ্রেয়ার বক্তব্যে যুক্তি খুঁজে পান। ফলে রায় শ্রেয়ার পক্ষেই আসে।
রায়ে বলা হয়, ৬৬ (এ) ধারাটি সংবিধান পরিপন্থী, কারণ এটি বর্তমান সময়ের জন্য ক্ষতিকর বা জনগণকে বিশৃঙ্খল করতে পারে বলে প্রমাণিত নয়। একই সঙ্গে এই আইনে ‘আপত্তিকর’ বিষয়টির যথাযথ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মত প্রকাশ ও কথা বলার স্বাধীনতাবিষয়ক আলোচিত বিষয়টি রায়ের জন্য মুলতবি রাখা হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, অপব্যবহারের শঙ্কায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ (এ) ধারাটিকে অসাংবিধানিক বলা যাবে না। শুনানিতে বলা হয়, মত প্রকাশ ও কথা বলার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কোনো ইচ্ছা সরকারের নেই, তবে অনলাইনকে অনিয়ন্ত্রিত রাখা যাবে না। শুনানি চলাকালে সুপ্রিম কোর্ট আইনের কিছু শব্দের ব্যাপারে আপত্তি জানান। এসব শব্দের মাধ্যমে আইনের অপপ্রয়োগের সুযোগ থাকে বলে জানান আদালত।
এ ব্যাপারে দেশটির তথ্য ও প্রযুক্তিমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, ‘যারা ক্ষমতায় আছে তাদের নিশ্চয়ই উদারনৈতিক হতে হবে, ভারত একটি স্বাধীন দেশ। ভারত সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানাচ্ছে।’