সমগ্র বাংলাদেশ ‘টাকার উপর’ চলে
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণভাবে অতিরিক্ত পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও লরি চলাচল করছে। এতে একদিকে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মহাসড়কসহ মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতু। চালকরা বলছেন, মহাসড়কে টহলরত পুলিশ ও সেতু কর্তৃপক্ষের লোকজনকে ঘুষ দিয়ে তাঁরা অতিরিক্ত মালামাল বহন করছেন।
urgentPhoto
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার মেঘনা ও কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার মেঘনা-গোমতী সেতু ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেতু দুটি সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কার্স অর্গানাইজেশনকে (পশ্চিম)। তারা ৪৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি সেতুর সংস্কারকাজ করে। প্রায় সাত মাস সংস্কার করার পর ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল সেতু দুটি খুলে দেওয়া হয়।
দুটি সেতুতে অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহনের ফলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে, এ ব্যাপারে কথা হয় সেতুর সংস্কার প্রকল্পের তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সেতু দুটি মেরামতের পর কীভাবে পরিচালনা করতে হবে, তা লিখিতভাবে সড়ক ও জনপথের কাছে হস্তান্তর করে দিয়েছি। প্রতিটি জিনিসের নির্ধারিত ধারণক্ষমতা থাকে। তারা ওভারলোডিং পরিহার করে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারলে সেতু দুটি নির্ধারিত ১০ বছরের চেয়েও বেশি দিন টিকে থাকবে।’
সওজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পণ্যবাহী যানবাহনগুলো তাদের কাঠামোর বাইরে কোনো পণ্য বহন করতে পারবে না। কাঠামোর ওপরেও উঁচু করে পণ্য বহন করা যাবে না। এ ছাড়া ট্রাকগুলো পাঁচ টনের বেশি মালামাল বহন করতে পারবে না।
কিন্তু ওই নিয়ম ভঙ্গ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল করে। সম্প্রতি এক রাতে চান্দিনা বাসস্ট্যান্ডে থেমে থাকা একটি ট্রাকে দেখা যায়, বিপুল পরিমাণ কাঠ। ট্রাকের কাঠামোর বাইরেও অনেক উঁচু করে কাঠ রাখা হয়েছিল।
কথা হয় ট্রাকশ্রমিক রসুল আহমদের সঙ্গে। তিনি জানান, ট্রাক নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন। জানতে চাওয়া হয় অতিরিক্ত পণ্য বহনের নিয়ম আছে কি না। তিনি বলেন, ‘এটা আসলে ওভারলোড নয়। গাছগুলো দেখতে অনেক (ভারী) লাগে। কিন্তু তেমন ওজন না।’
ট্রাকের কাঠামোর বাইরে গাছ নেওয়ার নিয়ম আছে কি না—জানতে চাইলে রসুল আহমদ বলেন, ‘আইনগতভাবে তো নাই।’ তাহলে কীভাবে বহন করছেন, পুলিশ দেখে না?
জবাবে রসুল আহমদ বলেন, ‘অবশ্যই দেখে। টাকা লইতাছে।’
কত টাকা নেয়?
‘একশ টাকা নেয়, দুইশ টাকা নেয়, পাঁচশ টাকা নেয়।’
কোন স্থানে নেয়? নাকি যেখানে দেখে?
‘যেখানে দেখে। যেখানে যেখানে টহলে পড়ে।’
এ পর্যন্ত কোন কোন স্থানে টাকা দিয়েছেন?
‘চিটাগাংয়ে দিছি। অনেক দিকে দিছি তো। অনেক জায়গায় দিছি, এখন কয়টার নাম বলব।’
এ পর্যন্ত কত টাকা দিয়েছেন?
এ সময় পাশ থেকে ট্রাকচালক বলেন, ‘টোটাল দুই হাজার টাকা লাগছে এ পর্যন্ত আসতে।’
ট্রাকচালকের নাম মো. ইকবাল হোসেন। বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায়। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, এভাবে অতিরিক্ত পণ্য বহনের অনুমতি আছে কি না।
ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আইনগত নিয়ম নাই। কিন্তু বাংলাদেশ টাকার উপর চলে।’
কীভাবে আনলেন? পুলিশ ধরে না?
‘পুলিশ যেখানে ধরছে, টাকা দিছি। যেখানে ধরে নাই, চলে আসছি।’
এই গাছ কোথা থেকে উঠিয়েছেন?
‘চট্টগ্রাম বন্দর থেকে।’
যাবেন কোথায়?
‘ঢাকা।’
এ পর্যন্ত কত টাকা দিয়েছেন?
‘প্রায় সতেরোশ-আঠারোশ টাকা লাগছে।’
আরো লাগতে পারে?
‘তা তো অবশ্যই। দাউদকান্দি স্কেলে (ওজন মাপার স্থান) দিতে হইব সাড়ে তিন হাজার টাকা।’
গত বুধবার দুপুরে চান্দিনা উপজেলা গেটের পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে কাঠবোঝাই একটি ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ট্রাকের কাঠামোর বাইরে ওপরে বিপুল পরিমাণ কাঠ ছিল। এর চালক রাস্তার পাশে এক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছিলেন। চালকের পাশের আসনে বসেছিলেন খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার চিকনপাড়া গ্রামের হাসান। তিনি খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলা থেকে কাঠ নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন।
হাসানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ট্রাক আটকে রেখেছে কে?
‘ওই সামনে পুলিশে। ওরা টাকার জন্য। দুই-একশ টাকা দিলে ছাইড়া দেয়।’
কতক্ষণ আগে আটক করেছে?
‘এই তো আধা ঘণ্টা হইব আটকাইছে।’
কী বলে আটক করেছে?
‘ওদেরকে টাকা দেওয়ার জন্য। মানে ৫০০ টাকা চাইতাছে। আমরা তো দুই-একশ টাকা দিয়া চইলা যাই। ওরা কইতাছে, না, ৫০০ টাকা দিতে হইব।’
এ পর্যন্ত আসতে কত টাকা দিয়েছেন?
‘এ রকম ১০০ বা ২০০—এ রকম দিয়া যাইতাছি।’
চান্দিনা পার হতে কত টাকা লেগেছে?
‘হিসাব করতে গেলে অনেক। হিসাব রাখি নাই। প্রত্যেক জায়গায় জায়গায় পুলিশ ধরে।’
আনুমানিক কথা টাকা দিয়েছেন?
‘আনুমানিক ১০ হাজার টাকা দিছি।’
দাউদকান্দি ওজন স্কেলে ধরে নাকি?
‘দাউদকান্দির ওখানে ফরেস্টার আছে। ফরেস্টাররে দেওন লাগে।’
গাড়ি ওজন করে? ওজনে মাল বেশি হবে, না কম হবে?
‘না। ওজনে মাল বেশি হবে না।’
তার পরও টাকা দিতে হবে?
‘গাড়িতে ওজনের টাকা দেওয়া লাগে।’
হাসানের সঙ্গে কথা শেষে ফেরার পথে ছুটে আসেন ট্রাকচালক আবুল কাশেম। কত টাকা দিয়েছেন—জানতে চাইলে বললেন, ৬০০ টাকা দিয়েছেন পুলিশকে।
পরিবহন শ্রমিকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া প্রসঙ্গে দাউদকান্দি টোলপ্লাজায় নিয়োজিত উপসহকারী প্রকৌশলী মো. জাকির আলম বলেন, ‘এখানে টাকা দেওয়ার কোনো নিয়ম নাই। ওজন করতেও কোনো টাকা লাগে না। তারা কেন টাকা দেবে? তা ছাড়া আমি তো সব সময় ডিউটি করতে পারি না। বড় বড় গাছ নিয়ে ওভারলোড করে ট্রাক যেতেও দেখিনি, যেকোনো ওভারলোড পণ্যবাহী ট্রাক দেখলে আমরা তা ঘুরিয়ে দিই, মাঝেমধ্যে মামলা নিই।’ তিনি জানান, একটি ট্রাক পাঁচ থেকে সাত টন পর্যন্ত মালামাল বহন করতে পারে।
মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণভাবে মাল বহনকারী পরিবহন চলাচলের ব্যাপারে পূর্বাঞ্চল হাইওয়ের পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মহাসড়কে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলার কথা নয়। ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাচল করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিভিন্ন স্থানে পুলিশকে টাকা দিয়ে অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল করছে—পরিবহন শ্রমিকদের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কেউ সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ করেনি। আমাদের সবাইকে বলা আছে, সড়কে কোনো চাঁদাবাজি চলবে না।’
মহাসড়কে অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন চলার ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেলার সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী রৌশমী এ ফাতিমা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ওজন স্কেলের দায়িত্ব আমরা টোল প্লাজাকে দিয়েছি। মাঝেমধ্যে আমরা সেখানে যাই। তখন তো আমরা দেখতে পাই না। তবে যে ব্যক্তি টাকা দিয়েছে, তাকে রিমাইন্ডার দিলে বের হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে আমরা অ্যাকশন (ব্যবস্থা) নেব।’