মুন্সীগঞ্জে ডিসি ও সাংবাদিকদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. সাইফুল হাসান বাদল সম্প্রতি আটটি পত্রিকার প্রকাশনা ছাড়পত্র (ডিক্লারেশন) বাতিল করেছেন। সেই সঙ্গে জেলায় কর্মরত বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমের ১১ সাংবাদিককে ‘উচ্ছৃঙ্খল’ আখ্যা দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে প্রেস কাউন্সিলে চিঠি দিয়েছেন। তাঁর ওই চিঠির পর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সুপারকে চিঠি দিয়েছে প্রেস কাউন্সিল।
ওই ১১ সাংবাদিকের দাবি, যে দিনের ঘটনার জন্য জেলা প্রশাসক তাঁদের বিরুদ্ধে চিঠি দিয়েছেন, ওই দিন তাঁদের নয়জনই ঘটনাস্থলে ছিলেন না। জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের একটি পক্ষের অবস্থান নিয়ে তাঁদের হেয় প্রতিপন্ন করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রেস কাউন্সিলে চিঠি দিয়েছেন এবং আটটি পত্রিকার প্রকাশনা ছাড়পত্র বাতিল করেছেন। এ ছাড়পত্র বাতিল হওয়ায় জেলা সদর থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুন্সীগঞ্জের কাগজ ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিক্রমপুর চিত্র ছাড়া আর কোনো পত্রিকা রইল না।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত : অভিযোগ ওঠা সাংবাদিক ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ২০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদলের সাথে ভিডিও কনফারেন্স করেন। এ জন্য জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে নির্ধারিত ৭৩টি আসনের সবই ভরা ছিল। সাংবাদিকদের জন্য কোনো আসন ছিল না।
জেলা প্রশাসক সাইফুল হাসান বাদল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ওই দিন যেই মুহূর্তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সে আসেন, সেই মুহূর্তে সাংবাদিক মীর নাসির উদ্দিন উজ্জ্বল ও জসিমউদ্দিন দেওয়ান এবং ১০-১২ জন ক্যামেরাম্যান হুট করে ঢুকে ছবি তোলা শুরু করেন। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ায় সাংবাদিকদের পাশের রুমে বসতে বলা হয়। কিন্তু তাঁরা উল্টো আমার বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলে পরে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করলেন। যাঁরা কর্মসূচি পালন করলেন, তাঁদের দুজন ছাড়া কেউ সেদিনকার প্রকৃত ঘটনা জানেন না। এমনকি তাঁরা কেউ একবারও ঘটনা জানতে আমাকে ফোনও করেননি। তাঁরা তো আমার ভাইয়ের মতো। সাংবাদিকদের আমি বরাবর সহযোগিতা করে আসছি।’
জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলে বোঝা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভিডিও কনফারেন্সের মতো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হুট করে ঢুকে পড়া এবং এরপর তাঁর বক্তব্য না নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে কুশপুত্তলিকাদাহ তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করার ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ হন। এই ঘটনা তদন্ত করার জন্য তিনি বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলে চিঠি পাঠিয়েছেন।
তবে এ ধরনের অভিযোগে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার এখতিয়ার না থাকায় প্রেস কাউন্সিল অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে গত ১৭ মে জেলার পুলিশ সুপারকে একটি চিঠি দেয়। চিঠিটি গত মঙ্গলবার মুন্সীগঞ্জে পৌঁছায়।
যেসব সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁরা হলেন মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি এবং যায়যায়দিন ও গাজী টিভির শহীদ-ই-হাসান তুহিন, প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকমের কাজী সাব্বির আহমেদ ওরফে দিপু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সমকালের মামুনুর রশীদ, মানবজমিনের মোজাম্মেল হোসেন সজল, আমাদের সময়ের মাহবুব বাবু, মাই টিভির শেখ মো. রতন, এনটিভির মাইনুদ্দিন সুমন, আরটিভির মো. ফরিদুল হাসান, ৭১ টেলিভিশনের জসিমউদ্দিন দেওয়ান এবং ক্যামেরাম্যান জাফর মিয়া ও আবদুর রহমান।
এদের মধ্যে সমকাল ও বাংলানিউজের প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে মাদকসেবনের অভিযোগও পুলিশকে তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলেছে প্রেস কাউন্সিল।
আট পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল : দীর্ঘদিন প্রকাশনা বন্ধ থাকার কথা বলে মুন্সীগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জেলা প্রশাসক গত বুধবার ২০ মে জেলা থেকে প্রকাশিত আটটি সংবাদপত্রের প্রকাশনা ছাড়পত্র (ডিক্লারেশন) বাতিল করেন। সংবাদপত্রগুলো হলো দৈনিক দেশসেবা (সম্পাদক জাহাঙ্গীর হাবিবউল্লাহ), সাপ্তাহিক মুন্সীগঞ্জ (সম্পাদক এ এফ এম এ রহমান), সাপ্তাহিক মুন্সীগঞ্জ সংবাদ (সম্পাদক শহীদ-ই-হাসান তুহিন), সাপ্তাহিক বিক্রমপুর সংবাদ (সম্পাদক মুহাম্মদ আজিম হোসেন), সাপ্তাহিক কাগজের খবর (সম্পাদক এস কে এমডি জাকির হোসেন সুমন), সাপ্তাহিক মুন্সীগঞ্জের বাণী (সম্পাদক মো. আবদুল হাকিম), সাপ্তাহিক সত্যপ্রকাশ (সম্পাদক জসিমউদ্দিন দেওয়ান) এবং পাক্ষিক খোলা কাগজ (সম্পাদক আবদুল বাতেন)।
সাংবাদিকরা যা বলেন : সাপ্তাহিক মুন্সীগঞ্জ সংবাদের সম্পাদক ও মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি শহীদ-ই-হাসান তুহিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘২০ এপ্রিলের প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সে আমি, মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু, এনটিভির জেলা প্রতিনিধি মঈনউদ্দিন সুমনসহ ১১ জনের নয়জনই যাননি, তাঁদের নামে ডিসি অভিযোগ করেছেন। আবার জনকণ্ঠের সাংবাদিক মীর নাসির উদ্দিন উজ্জ্বলসহ আরো বেশ কিছু সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন ওই দিনের ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠানে, যাঁরা ডিসি বেরিয়ে যেতে বললে বেরিয়ে যান। তাঁদের মধ্য থেকে মীর নাসির উদ্দিন উজ্জ্বলসহ কয়েকজনকে বাদ দিয়ে ডিসি প্রেস কাউন্সিল বরাবর অভিযোগ করেছেন। এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
শহীদ-ই-হাসান তুহিন আরো বলেন, সাপ্তাহিক মুন্সীগঞ্জ সংবাদের প্রকাশ এক বছরের মধ্যে বন্ধ না থাকলেও ডিসি বেআইনিভাবে আটটি পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করেছেন। অথচ দৈনিক মুন্সীগঞ্জের কাগজের নির্বাহী সম্পাদক মীর নাসির উদ্দিন উজ্জ্বল হওয়ায় তাঁর সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বহাল রেখেছেন।
মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কাজী সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘প্রেসক্লাবের কোন্দলের জেরে জেলা প্রশাসক একটি পক্ষের জন্য অবস্থান নিয়েছেন। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সের তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে জেলা প্রশাসক আমাদের কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে রূঢ় ভাষায় কথা বলে বের করে দেন। এর বিরুদ্ধে সাংবাদিকরা আন্দোলন করায় জেলা প্রশাসক এ অভিযোগ দেন।’
কাজী সাব্বির বলেন, তাঁকে ও তাঁর সহকর্মী মামুনুর রশীদকে সমাজে হেয় করতেই মাদক সেবনের মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে।
দৈনিক মানবজমিনের স্টাফ রিপোর্টার মোজাম্মেল হোসেন সজল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ভিডিও কনফারেন্সে যাওয়ার জন্য আমাকে চিঠি দেয়নি বলে আমি সেখানে যাইনি। আমাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জড়ানো হয়েছে।’
আরটিভির জেলা প্রতিনিধি ফরিদুল হাসান বলেন, ‘আমি ওই দিন ডিসির সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত না হলেও, আমাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জড়ানো হয়েছে।’
সাপ্তাহিক সত্যপ্রকাশের সম্পাদক ও ৭১ টিভির জেলা প্রতিনিধি জসিমউদ্দিন দেওয়ান বলেন, ‘২০ এপ্রিল জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্স থেকে আমাকেসহ সাংবাদিকদের বের করে দেওয়ার প্রতিবাদে জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের আন্দোলনের খবর সাপ্তাহিক সত্যপ্রকাশে পরিবেশনের দায়ে এ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়েছে।’
সাপ্তাহিক বিক্রমপুর সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসকের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র প্রকাশিত হওয়ায় জেলা প্রশাসক ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করেছেন।’
সাংবাদিকদের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা প্রশাসক সাইফুল হাসান। তিনি বলেন, ‘আমি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা অনেক খোঁজ-খবর নিয়ে ওই সব পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করেছি। এর মধ্যে অনেক পত্রিকার নিজস্ব কার্যালয় নেই। একটি পত্রিকা ১৯৯৬ সালে একবার বের হওয়ার পর আর কোনো সংখ্যা প্রকাশ করেনি। পত্রিকাগুলো কোনোটাই ছয় মাস থেকে এক বছরের বেশি সময় ধরে প্রকাশিত হচ্ছে না। তাঁদের প্রকাশনা সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনেও কেউ যোগাযোগ করেনি। এমনকি কেউ আমাকে একবার ফোনও দেয়নি। তাদের অনিয়মিত কোনো সংখ্যা প্রকাশিত হলেও তাঁরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারত। কিন্তু কেউ করেনি।’