সব ভেদাভেদ ভুলে নজরুলের স্বপ্নপূরণের আহ্বান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে শোষণ-বঞ্চনামুক্ত একটি সুখী সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্বপ্ন পূরণ হবে। সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে নজরুলের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, কবি নজরুল এ লক্ষ্যে আমাদের জন্য একটি বিরাট অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।
প্রধানমন্ত্রী আজ সোমবার কুমিল্লার টাউন হল মাঠে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় কর্মসূচির উদ্বোধনকালে এসব কথা বলেন।urgentPhoto
অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের নির্মূল না করা পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণ লড়াই চালিয়ে যাবে। শেখ হাসিনা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কুমিল্লাকে বিভাগ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় কবির স্বপ্ন অনুযায়ী সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনামুক্ত একটি আলোকিত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লড়াই ছিল একটি শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। নজরুলও একই আদর্শের পূজারি ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নজরুলের একটি কবিতা থেকে বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি বেছে নিয়েছিলেন। জাতির জনকের ভরাট কণ্ঠ এবং নজরুলের গান জাতিকে স্বাধীনতা লাভের জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
নজরুলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নজরুলের ১১৬তম জন্মজয়ন্তীর জাতীয় কর্মসূচি কুমিল্লায় উদযাপন করা হচ্ছে। এখানে কবির অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। এটি কুমিল্লার জনগণের গর্ব ও আনন্দের বিষয়।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, নজরুল ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও স্থানীয় সংসদ সদস্য এ কে এম বাহাউদ্দিন বাহার অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন। অধ্যাপক শান্তনু কায়সার অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তব্য দেন। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব বেগম আখতারী মমতাজ স্বাগত বক্তৃতা করেন। জেলা প্রশাসক হাসানুজ্জামান কল্লোল ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় প্রতিভার নাম কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে তাঁর অবদান অসামান্য। নজরুলের জন্ম হয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু তিনি তাঁর কবি প্রতিভা বিকাশের জন্য প্রচুর রসদ পেয়েছেন এ দেশের মাটি ও মানুষের কাছ থেকে। বাংলাদেশের মাটি আর মানুষের সাথে ছিল তাঁর নিবিড় এবং আত্মিক সম্পর্ক।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নজরুলের জীবনে কুমিল্লা বিশেষ জায়গা দখল করে নিয়েছিল। তিনি তাঁর জীবনের বিশেষ একটা সময় অতিবাহিত করেন কুমিল্লায়। ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে তিনি প্রথম কুমিল্লায় আসেন। এরপর ১৯২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচবার এসেছেন এবং মোট প্রায় এক বছর কাটিয়েছেন কুমিল্লায়। সবচেয়ে বড় কথা তিনি কুমিল্লার মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তা প্রমীলাকে বিয়ে করেন। এই কুমিল্লাতেই ছিল কবির মানসপ্রিয়া নার্গিস।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দোলনচাঁপা, অগ্নিবীণা, ছায়ানট, ঝিঙ্গেফুল, পূবের হাওয়া প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা তিনি এখানে বসে লেখেন। কুমিল্লা তাঁকে আগুনের পরশমণি দিয়েছিল। আর সে জন্য তিনি বাজাতে পেরেছিলেন অগ্নিবীণা। ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতার জন্য কবিকে কুমিল্লা থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, পরাধীন ভারতের এক অস্থির সময়ে কবি নজরুলের জন্ম। পরাধীনতার শৃঙ্খল তাঁকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। একই সঙ্গে ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার, নারীর প্রতি বৈষম্য এবং শোষণের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তাঁর লেখনীতে আমরা তাই যেমন নারী-পুরুষের সম-অধিকারের কথা পাই, তেমনি পাই কুলি-মজুর, কৃষকসহ বাংলার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ব্যথা-বেদনার কথা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে নজরুলের সাহিত্য বাঙালি জাতিকে আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে। পরাধীন ভারতের মুক্তি সংগ্রামের অগ্রসেনানী ছিলেন তিনি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কবিতা ও গান সমগ্র বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের শক্তি জুগিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, অতি সাধারণ পরিবারে নজরুলের জন্ম। কঠিন বাস্তবতা আর দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। জীবিকার জন্য কিশোর বয়সেই তাঁকে উপার্জনে নেমে পড়তে হয়েছিল। অন্যের বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশোনা করেছেন। অসম্ভব প্রতিভাধর কবি এখানে প্রথম হয়ে নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও তিনি একটানা বেশিদিন থাকতে পারেননি। তবে কঠিন জীবনসংগ্রাম তাঁকে দমাতে পারেনি। বরং তিনি খাঁটি মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন; অন্যকেও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের অধিকারের কথা বলায় ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। অপরদিকে ধর্ম ব্যবসায়ী ফতোয়াবাজদের মুখোশ খুলে দেওয়ার কারণে ‘কাফের’ নামেও অভিহিত হয়েছিলেন।
নজরুলকে মানবতা ও সাম্যের কবি হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব কিছুর ওপর যে মানুষ বড়, এ কথা তিনি বারবার উচ্চারণ করে গেছেন। নজরুলের কাব্য ভাবনার এক প্রধান অংশ জুড়ে রয়েছে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি।
শেখ হাসিনা বলেন, নজরুল একদিকে যেমন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শ্যামাসংগীত রচয়িতা, তেমনি অন্যদিকে বাংলা ইসলামী গানের প্রবর্তকও। তিনি যেমনি ছিলেন বিদ্রোহী কবি, তেমনি ছিলেন প্রেমের কবি। তাঁর এই প্রেম শুধু মানবীকে ঘিরে নয়। এই প্রেম ছিল দেশের সাথে, মাটির সাথে, মানুষের সাথে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নজরুল আমাদের জাতীয় জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। তাই ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে বঙ্গবন্ধু বিদ্রোহী কবির ‘চল চল’ গানটিকে বাংলাদেশের রণসঙ্গীত হিসেবে নির্বাচন করেন। এর কিছুদিন পর কলকাতা সফরের সময় কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসার ব্যাপারে কবির পরিবারের সাথে কথা বলেন বঙ্গবন্ধু।’
শেখ হাসিনা বলেন, সে অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু কলকাতায় প্রতিনিধি পাঠান। ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে সপরিবারে কলকাতা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। কবির জন্য ধানমণ্ডির ২৮ নম্বর রোডের ৩৩০ নম্বর বাড়িটি বরাদ্দ দেন বঙ্গবন্ধু। তাঁকে জাতীয় কবির সম্মানে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই কবি ভবনে কবিকে দেখতে যেতেন এবং তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নিতেন। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডি. লিট উপাধি প্রদান করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতীয় কবির প্রতি সম্মান জানানো আমাদের কর্তব্য। আওয়ামী লীগ যখনই সরকারে এসেছে নজরুলের স্মৃতি রক্ষা এবং নজরুলচর্চায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আমরা নানা আয়োজনে দুই বছরব্যাপী নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করি।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী কুমিল্লায় ১০টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন এবং নয়টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
পরে প্রধানমন্ত্রী নজরুলের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত একটি সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন।