ইফতারের সময় তিস্তাপাড়ে কান্নার রোল
‘হঠাৎ করে আছরের নামাজের পর থেকে হু হু করে বাড়তে থাকে তিস্তার পানি। কিছু বুঝে উঠার আগেই বাড়িতে ঢুকতে থাকে পানি। এর পর সন্ধ্যায় অন্ধকার নামতে না নামতেই যা ছিল তার সবটাই নদীগর্ভে।’
আজ বুধবার ঠিক ইফতারের সময় কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভ্যানচালক শফিকুল ইসলাম (৩৬)। বিকেল পর্যন্ত তাঁর বাড়ি ছিল লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার চর গড্ডিমারী এলাকার বাঁধে। নদীগর্ভে বসতবাড়িটি চলে যাওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে রাতে কোথায় থাকবেন জানেন না তিনি।
আজ ইফতারের আগে ও পরে শফিকুলের মতো অবস্থায় পড়েছেন লালমনিরহাটের তিস্তাপাড়ের অসংখ্য মানুষ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভারত থেকে আসতে থাকা পানি বৃদ্ধি পেতে থাকে। ওপারে জারি করা হয় রেড অ্যালার্ট বা লাল সতর্কতা। ফলে এপারে তিস্তার প্রবেশদ্বার তিস্তা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ নেয় বাড়তি সতর্কতা। পানির চাপ কমাতে ব্যারাজের ৪৪টি গেটের সবকটি খুলে দেওয়া হয়। ব্যারাজ পয়েন্টে দ্রুত বাড়তে থাকে পানির গতি। রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া রাত ১০টায় হাতিবান্ধা এলাকায় তিস্তাপাড়ের সব মানুষকে নিজম্ব মালামাল নিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান রাত সাড়ে ৯টায় এনটিভি অনলাইনকে বলেন, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ব্যারাজ রক্ষায় নির্মিত ফ্লাড বাইপাস কেটে দেওয়াসহ রেড অ্যালার্ট জারি করা হতে পারে।
সন্ধ্যায় হাতীবান্ধার চর গড্ডিমারী ও নিজ গড্ডিমারী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, যে সময়ে মানুষের ইফতারের আয়োজন করার কথা ঠিক সে সময়ে সেখানে পড়েছে কান্নার রোল। লোকজন যে যেভাবে পারছে নিজের শেষ সম্বলটুকু নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কেউ বা নিজের থাকার ঘরটি রক্ষায় চালাচ্ছে প্রাণপণ চেষ্টা।
আবার স্থানীয় লোকজন নিজেরাই বালুর বস্তা দিয়ে নদীর ভাঙন রক্ষার চেষ্টা করছে। সেখানকার লোকজন জানায়, সন্ধ্যায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অন্তত ৫০টি বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
হাতীবান্ধার চর গড্ডিমারী এলাকার একজন দিনমজুর সন্ধ্যায় কাঁদতে কাঁদতে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি একটু ক্ষেতে গেছিলাম। আইসা দেখি হুট কইরা পানি। একজনে ফোন কইরা কইল, তোমার বাড়ি তো থাকে না। আমি দৌড় পাইড়া আইসা দেখি বাড়িঘরে পানি। আমার তো এক শতক জায়গাও নাই যে, আমি ঘরটা নিয়া হেই জায়গায় রাখুম। সরকারি জায়গায় ছিলাম। এখন তো তিস্তা নদীর বন্যায় হেইডাও শেষ কাইরা দিল। বেলা ৩টা থেইকা এখন পর্যন্ত এই অবস্থা।’
নিজ গড্ডিমারী এলাকার এক গৃহবধূ বলেন, ‘হঠাৎ কইরাই আসরের আজানের পর থেইকা পানি আসা শুরু করছে। আমি জোহরের নামাজের পর কোরআন শরিফ পড়ে বাইরে বের হই। আইসা দেখি খালি পানি আর পানি।’
এদিকে ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বৃদ্ধির ফলে হাতীবান্ধা উপজেলার আরো কয়েকটি এলাকাসহ পাটগ্রাম, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার অন্তত ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে তাৎক্ষণিকভাবে জানা গেছে।
হাতীবান্ধার গড্ডিমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন বুলু বলেন, আকস্মিকভাবে বুধবার বিকেল থেকে বাড়তে থাকে নদীর পানি। এতে শুধু তাঁর ইউনিয়নেরই কমপক্ষে অর্ধ শতাধিক বাড়ি হুমকির মধ্যে রয়েছে।