স্মরণ
শাকিল আসলে লেখক হতে চেয়েছিল
শাকিলের সঙ্গে আমার পরিচয় খুব খারাপ ঘটনার মধ্য দিয়ে। ঘটনার মাস তিন পরে আমি তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাই, গ্রহণ করি আর দেখি আমাদের বন্ধুচক্রের অনেকের সঙ্গেই তার খুব দহরম-মহরম সম্পর্ক, আড্ডা, আসর। আমি অল্পদিনের মধ্যেই সে আড্ডার সঙ্গী হয়ে যাই এবং দ্বিতীয় আড্ডার দিন থেকেই আমাদের সম্পর্ক আপনি-আপনি থেকে তুমি-তুমি, কখনো বা তুই-তুইতে নেমে আসে।
এর আগে মাহবুবুল হক শাকিল নামে কারো কবিতা আমি কোথাও কোথাও দেখেছি, পড়িনি কখনো। খুব অচেনা কোনো কবির কবিতা আমার তেমন পড়াই হয় না। কিন্তু আসরে-আড্ডায় বসে দেখি, সে আসলেই ভালো কবি এবং আড্ডার ফাঁকে ফাঁকেই সে নতুন নতুন কবিতার লাইন আওড়াচ্ছে—কখনো নিজের, কখনো অন্যের ফোনের ভয়েস রেকর্ডারে সেগুলো রেকর্ড করিয়ে রাখছে এবং হয়তো সেদিনের গভীর রাতেই ফোন করে ঘুম ভাঙিয়ে আজ সন্ধ্যায় ভ্রুণ জন্মানো কবিতাটি প্রসব করে টেলিফোনে শুনিয়ে দিচ্ছে এবং পরের শুক্রবারের দৈনিকের সাহিত্যপাতায় তা হয়তো ছাপাই হয়ে যাচ্ছে।
তার আড্ডায় দুই প্রকারের লোক আসত। প্রথম প্রকারেরগুলোকে সে বারবার ডেকে নিয়ে আসত। তার ডাক অগ্রাহ্য করার মুরোদ থাকত না কারোরই। দ্বিতীয় প্রকারেরগুলো নানা কারণে তার সঙ্গে দেখা করতে আসত এবং কৌশলে তার সঙ্গে একটু কথা বলে, সেলফি তুলে চলে যেত। ঘর পেরিয়ে রাস্তায় ওঠার আগে তিনি সেই ছবি ফেসবুকে দিয়ে তাঁর সঙ্গে শাকিলের ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি জানান দিয়েও দিতেন। আবার রেগুলার আড্ডাবাজির শেষেও সে প্রায় প্রতিদিনই দলবেঁধে ছবি তুলে নিজেই ফেসবুকে পোস্ট করত।
আমি তখন লক্ষ করতাম যে হঠাৎ করে আমার কাছে আসা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট বেড়ে যেত। শাকিলের সঙ্গে তোলা আমার পোস্ট করা ছবির নিচে অপরিচিত লোকদের প্রশংসার বন্যা বইতে দেখে কখনো কখনো অবাকই হতাম। শাকিলকে বলতাম এ ঘটনার কথা। শুনে সে হাসত। বলত, এর পরে তারা তোমার সঙ্গে ইনবক্সে কথা বলা শুরু করবে এবং এর পর কী কী তোমাকে বলবে, আমি বলে দিতে পারি। কিছুদিনের মধ্যে লক্ষ করি, ঘটনা সত্যি। আমাকে ফোন করা, মেসেজে বলা শুরু হয়ে গেছে। আমরা কখন কোথায় বসব, তিনি একটু আসতে চান, আড্ডায় যোগ দিতে চান। কেউ কেউ হাসপাতালে গিয়ে শাকিলের আম্মার সঙ্গে দেখা করে একটা সেলফি তুলে হয়তো আমাকে ইনবক্স করছেন, বলছেন, শাকিল ভাইকে জানাবেন যে আমি গিয়েছিলাম, খালাম্মাকে দেখে এসেছি।
আমার এমনিতে কোনো ক্ষমতাভাগ্য নেই। কোনো ক্ষমতাবান লোকের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য নেওয়ার সুযোগ আমার হয়নি, কিন্তু শাকিলের সঙ্গে কিছুদিন মেশার পরপরই আমি বুঝতে পারি, শাকিল অনেক ক্ষমতাবান। সে অনেকের চাকরি দিতে পারে, অনেকের বদলি করাতে, বদলি ঠেকাতে পারে। পুলিশ-র্যাব ম্যানেজ করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, যাঁদের দেখলে মনে হয় যে এঁদের হুঙ্কারে বাঘে-মোষে এক ঘাটে পানি খেতে পারে, এমন রাজনীতিবিদ বা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মোড়ল প্রকৃতির লোকেরা তাকে যে পরিমাণ তোয়াজ করছে, তাঁদের এসব শাকিল-তোষণ আমাকে প্রায়ই বিচলিত করত। কিছুটা সে বুঝতও। মজা করার জন্য এমন কথা আমাদের আড্ডায় বহুদিন বলেছে, সে যে তিনজনকে ভয় পায়, আমি সেই দলের তৃতীয়। আমি জানি, এটা হয়তো আমাকে খুশি করার জন্য বলা। আমি শুনে হাসতাম এবং ভেতরে ভেতরে খুশিই হতাম। সবাই তাকে খুশি করতে ব্যস্ত, আর সে আমাকে।
শাকিল অনেক বন্ধুবৎসল ছিল। দুই রকমের বন্ধুদের সঙ্গে তাকে দেখতাম একই আসরে। একশ্রেণির বন্ধুরা ছিল তার রাজনৈতিক দলের কর্মী, আরেক দলে ছিল লেখককুল। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিকে একসঙ্গে মেলালেও প্রথম শ্রেণিকে বেশিরভাগ সময়ই পত্রপাঠ বিদায় করে প্রাণের আড্ডায় বসত লেখকদের নিয়ে। সেখানে শাকিলই প্রধান বক্তা-গল্পকার, প্রধান কবি এবং কখনো কখনো একমাত্র গায়কও। আসরে শোনানো গল্প নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো কোনো সম্পাদক তাকে বুকিং দিয়ে দিচ্ছেন, কাল-পরশুর মধ্যে গল্পটি লিখে তাঁকে দিয়ে দিতে। তিনি সেটা নিজে ছাপাচ্ছেন বা অন্য কোথাও ছাপানোর বন্দোবস্ত করছেন। আসরে আওড়ানো কবিতার পঙক্তি রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে মোবাইল ফোনের ভয়েস রেকর্ডারে। এটা শুনে শুনে হয়তো আরেক সম্পাদক লিখে ফেলছেন তার কবিতা। বাসায় ফিরে মাঝরাতে হয়তো শাকিল সে কবিতাটি লেখা শেষ করল। তখন আবার ফোন করে পড়ে শোনাত। কখনো বা ভোরে উঠে দেখা যেত কবিতাটি ফেসবুকে দিয়ে দিয়েছে। এমন করে করে বেশ কিছু গল্প-কবিতার জন্মানো ভ্রুণকে অপরিপক্বভাবে ভূমিষ্ঠ করেছিল শাকিল। কোনো কোনো সপ্তাহে দেশের শীর্ষস্থানীয় তিন কাগজে ছাপা হতো তার তিন লেখা।
তার লেখা পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যেত শীর্ষ দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদকেরা। তার লেখার প্রশংসাবাচক রিভিউ করার জন্য মুখর ছিলেন কঠিন কঠিন সাহিত্য-সমালোচকেরাও। তাঁরা তার লেখাটাকেই পছন্দ করতেন, না তার সুনজরে থাকা পছন্দ করতেন, আমি এখনো এ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত।
শাকিলের বই প্রকাশের জন্য ব্যাকুল ছিলেন প্রকাশকেরা। দ্বিতীয় কবিতার বই ‘মন খারাপের গাড়ি’র প্রকাশনা অনুষ্ঠান হলো বাংলা একাডেমির এক হলে ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। সেখানে হলভর্তি দর্শক। ভেতরে দাঁড়ানোরও জায়গা নেই। যত লোক ভেতরে, আর তত বাইরে। শাকিলকে মঞ্চে বসিয়ে আলোচনা করছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় গ্রন্থবোদ্ধারা। আমি টেলিভিশনে ও অনলাইনের নিউজ ফিডে এর খবর পাই। আলোচকেরা কেউ কেউ তার কবিতার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মিল পেলেন, কেউ বললেন জীবনানন্দের পর এইরকম কবিতা শাকিলই লিখল। আমি তাজ্জব হয়ে শুনে গেলাম। বইমেলায় গিয়ে দেখি, আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে হাজার হাজার কপি বই তার বিক্রি হচ্ছে। সে স্টলে বসে অটোগ্রাফ দিতে পারছে না, ভিড়ের ঠেলায় স্টল ভেঙে যাওয়ার অবস্থা। বাইরে বসে সারাক্ষণই অটোগ্রাফ দিল। শুনলাম সে বছর সর্বোচ্চ সংখ্যক বিক্রীত বইয়ের তালিকায় তার এ বইটি আছে।
পরের বছর, ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তার নতুন কবিতার বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হবে। প্রকাশ করেছেন আগের প্রকাশক, উৎসব হচ্ছে ঠিক এক বছর পরে, একই জায়গায়। সবই আছে আগের মতো, শুধু শাকিল নেই। এবং লক্ষ করলাম, সেই মঞ্চে আগের বছরের বক্তারাও নেই। আছেন তার পরিবারের লোকজন। ২০১৭ সালের বইমেলার চত্বর ঘুরে বেড়াই। তার অনেকগুলো বই এবারও বেরিয়েছে। এক স্টলের ছাদে হুমায়ূন আহমেদের পাশে শাকিলের একটা বড় ছবিও টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখি, শাকিলের বইয়ের বিক্রির খবর খুব ভালো না।
জীবিত শাকিল আসলে কবি হতেই চেয়েছিল, কিন্তু পরিপূর্ণ কবি হওয়ার আগেই তাকে চলে যেতে হলো।
শাকিলকে নিয়ে আমার সুখস্মৃতির বয়স আট-নয় মাস মাত্র। এর মধ্যে তার সঙ্গে প্রাণ খুলে আড্ডা দিয়েছি দেশে-বিদেশে। তার আবদার অগ্রাহ্য করার শক্তি আমারও ছিল না বলে লন্ডনে বাংলাদেশ বইমেলায় তাকে সঙ্গ দিতে গিয়েছি, আমার কাজের জন্য রাজশাহী গেলে আমাকে সঙ্গ দিতে সেও রাজশাহী ছুটে গিয়েছে, এমন ঘটনাও আছে। সর্বশেষ আড্ডা ছিল আমার অফিসেই, আমার জন্মদিনে ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর। সেই আড্ডায়, বরাবরের মতোই মধ্যমণি হয়েছিল শাকিল। আলো ছড়িয়ে, সুধা হারিয়ে, দিয়েছিল প্রাণ, আর প্রাণ। কিন্তু কী এক কঠিন অভিমানে আমাদের ফতুর করে দিয়ে সে চলে গেল, বুঝতে পারলাম না। আমার পাগলা বন্ধুটা ভালো থাকুক।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
পুনশ্চ : প্রতিটা মৃত্যুই বাকি জীবিতদের জন্য একটা শিক্ষা রেখে যায়। বেকুব জীবিতদের বেশিরভাগেই এই শিক্ষাটা নিতে পারে না।