যুগে যুগে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব
শুভ জন্মাষ্টমী। শ্রীশ্রী কৃষ্ণের শুভ আবির্ভাব পূর্ণতিথি ‘অষ্টম’ বলেই এ নির্দিষ্ট তিথিটি ‘জন্মাষ্টমী’ নামে পরিচিত। এখন থেকে প্রায় পাঁচ হাজার ২৩২ বছর আগে অথবা খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার ২১৭ অব্দের ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে ও রোহিনী নক্ষত্রে ভারত ভূ-খণ্ডের মথুরা মণ্ডলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ আবির্ভাব হয়।
প্রচলিত আছে, এ রাতে শত বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয় তাঁর মামা কংসের কারাগারে। জন্মের পরই মাতা ও পিতার থেকে আলাদা হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বেড়ে ওঠেন যশোদা মায়ের কাছে। বাল্যকালে তাঁর সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার হাজারো গল্প প্রচলিত আছে। আর সেগুলোর মধ্যে দুষ্টু শৈশবের মিষ্টি খাওয়ার গল্প আমরা সবাই জানি। যৌবনে হাজারো সেনাকে মুহূর্তেই ভুপাতিত করার ইতিহাস ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এক অনন্য কাহিনী। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হয়েছেন দ্বাপর যুগের শেষ প্রান্তে ।
শ্রী গীতা-চতুর্থ অধ্যায়-৭ম ও ৮ম শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘হে ভারত (অর্জুন), যখন যখন ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, আমি সেই সময়ে নিজেকে সৃষ্টি করি (দেহ ধারণ পূর্বক অবতীর্ণ হই)। সাধুদিগের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।’ ঈশ্বর যখন জীব ও জগতের কল্যাণে জীবরূপ পরিগ্রহ করে ধরাধামে তথা মর্ত্যলোকে অবতীর্ণ বা আবির্ভূত হন, তখন তিনি ভগবানরূপে পরিজ্ঞাত হন।
এখন চলছে কলিযুগ, যার আয়ুষ্কাল কমপক্ষে ৪ লাখ ৩২ হাজার বছর। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকালে শ্রীকৃষ্ণের বয়স ছিল ৮০ বছর। তাই খ্রিস্টপূর্ব ৩২১৭ অব্দে শ্রীকৃষ্ণের আর্বিভাব। সুতরাং, চলতি ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর আবির্ভাবের (৩২১৭+ ২০১৫)= ৫২৩২ বছর পূর্ণ হলো।
ভগবান যুগে যুগে যখন প্রয়োজন তখন ভিন্ন ভিন্নরূপে আবির্ভূত হন। যেমন : সত্যযুগে তিনি শ্রীহরি রূপে, ত্রেতাযুগে শ্রী রাম রূপে, দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণরূপে এবং কলিযুগে কল্কিরূপে আবির্ভূত হন। তাই, পবিত্র শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় তিনি বলেছেন-
‘যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত/অভ্যুত্থানম ধর্মস্য তদাত্নানং সৃজাম্যহম
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম/ ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে’
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনের নিমিত্তে অবতার রূপে এই তিথিতে এ ধরাধামে আবির্ভূত হন।
শ্রীমদ্ভগবত গীতা স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখপদ্মনিঃসৃত উপদেশ সংবলিত গ্রন্থ। প্রিয় শিষ্য, তাঁর সখা তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনকে উপলক্ষ করে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে ভগবানের প্রত্যক্ষ বাণী ও উপদেশ পাওয়া যায় গীতাতে। ভক্ত ও ভগবানের এ কথোপকথন নিগূঢ় যোগতত্ত্ব সম্বন্ধীয় আলোচনা। ঠিক গুরু যেমন তাঁর অন্তরঙ্গ শিষ্যকে একান্তভাবে তত্ত্বজ্ঞান দান করেন, তত্ত্বের নির্যাস ভক্তকে আস্বাদন করানোর প্রয়াস পান, গীতাতে ভগবান জগৎগুরু শ্রীকৃষ্ণ তদ্রুপ প্রিয় শিষ্য অর্জুনকে তাঁর অজ্ঞানতার অন্ধকার বিদূরীত করতে জ্ঞানের দীপশিখা প্রজ্বালনের মাধ্যমে জীবনের মোক্ষপ্রাপ্তির পথ প্রদর্শন করেছেন।
গীতা বেদানুগ গ্রন্থসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। গীতা আমাদের নিত্যপাঠ্য ধর্মগ্রন্থ। কারণ, এটি সাধারণের কাছে সহজপাঠ্য । এ এক অনন্য জীবনদর্শন- যা আমাদের করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করে। সবকিছুর মধ্যে ভগবানের দর্শন এবং ভগবানের মধ্যে জগতের সবকিছু দর্শনের মাধ্যমে যোগী মূলত জাগতিক সুখ-দুঃখ, শত্রু-মিত্র, মান-অপমানের ঊর্ধ্বে উঠে অদ্বৈতের অনুভব অমৃতত্ত্ব লাভ করেন। সে ঈশ্বরসৃষ্ট সবকিছুকে ভালোবাসতে শেখে। সব সৃষ্টিতেই সে ভগবানকে খুঁজে পায়। কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ দুটি পরস্পরবিরোধী কর্তব্যের চাপে অর্জুন ভেঙে পড়েছিলেন। যে কোনো সমাজবদ্ধ মানুষের মতোই অর্জুনের মনে দেখা দিয়েছিল এক দ্বন্দ্ব। কর্তব্যবোধের দ্বন্দ্বে তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কোন পথে যাবেন তিনি? রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি তার কর্তব্যবোধ বলছে- ‘যুদ্ধ কর।’ আর পারিবারিক কর্তব্যবোধ বলছে, ‘যুদ্ধরূপ হিংসাত্মক কর্মের মাধ্যমে জ্ঞাতি, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও গুরুতুল্য ব্যক্তিগণকে হত্যা করা অনুচিত।’ চোখের সামনে নিজের আত্মীয়স্বজনকে দেখে তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রস্থান করতে চাইলেন। এ কর্তব্যবোধের দ্বন্দ্বে কোনটি অনুসরণ করবেন তা বুঝে উঠতে না পেরে অর্জুন হলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অর্জুনের এ সমস্যা জগতের প্রতিটি মানুষের জীবনেই দেখা দেয়। আমরাও জীবনে চলার পথে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত নিয়ে বিভিন্ন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। তখন আমাদের অর্জুনের মতোই চলার পথ দেখায় শ্রীমদ্ভগবদ গীতা বা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত বাণী। শ্রীকৃষ্ণ যেমন অর্জুনের রথের সারথি, তেমনি তিনি জগৎ জীবের দেহরথেরও সারথি। আমরা অনেক সময়ই আমাদের কর্তব্য বুঝে উঠতে পারি না। ভালো-মন্দ অনেক কিছু করেই একতরফা দোষারোপ করতে থাকি ভগবানের ওপর। তিনি পরম করুণাময়। জীবনে চলার পথে হোঁচট খাওয়ার মুহূর্তে শ্রীমদ্ভগবদ গীতা বা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ অনুধাবনের মধ্যেই জীবনের দিকনির্দেশনা খুঁজে পাওয়া যায় ।
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে দূর-দূরান্ত থেকে উপবাসব্রত পালনকারী ভক্তরা ফল-ফুল, তালের পিঠা এবং তেলের মালপোয়া দিয়ে শ্রদ্ধাসহকারে নৈবেদ্য সাজিয়ে পরম করুণাময় শ্রীকৃষ্ণের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। বহু ভক্ত ধূপ, দীপ জ্বালিয়ে কীর্তনসহকারে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের শুভ জন্মাষ্টমীর পূজায় অংশ নেন।
আজ সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন- বর্ণাঢ্য র্যালি, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, গীতাপাঠ , রচনা প্রতিযোগিতা, শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্য বর্ণনা এবং আলোচনা অনুষ্ঠানে যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হচ্ছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই আজ গুরুনাম স্মরণে মাতোয়ারা, নামসংকীর্তনে আজ মাতোয়ারা পুরো বিশ্বও। পূজা, অঞ্জলি ও মহাপ্রসাদ বিতরণের পাশাপাশি সংঘের ভক্তদের কীর্তন ভজনও পরিবেশন করবেন। কৃষ্ণ নামে আজ সবাই পালন করছে মহান জন্মাষ্টমী।