আপনার জিজ্ঞাসা
আমাদের নবী একজন, কিন্তু চার মাজহাব মানি কেন?
নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, পরিবার, সমাজসহ জীবনঘনিষ্ঠ ইসলামবিষয়ক প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠান ‘আপনার জিজ্ঞাসা’। জয়নুল আবেদীন আজাদের উপস্থাপনায় এনটিভির জনপ্রিয় এ অনুষ্ঠানে দর্শকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন বিশিষ্ট আলেম ড. মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ।
আপনার জিজ্ঞাসার ১৭২০তম পর্বে গাজীপুর থেকে ই-মেইলে ইসলামের মাজহাব সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন কাউসার। প্রশ্নোত্তরের ভাষান্তর করেছেন মুন্সী আবদুল কাদির।
প্রশ্ন : আমাদের নবী একজন, কিন্তু আমরা চার মাজহাব মানি কেন? নবী তো বলেছেন, আমাকে অনুসরণ করো। চার মাজহাবির লোক চারভাবে সালাত আদায় করে কেন? নবী তো বলেননি যে, মালয়েশিয়ার লোক একভাবে নামাজ আদায় করবে আর বাংলাদেশের লোক আরেকভাবে নামাজ আদায় করবে। আবার ভারতের লোক আরেকভাবে নামাজ আদায় করবে। এভাবে কী বলেছেন? আমাকে জানাবেন।
উত্তর : আসলে আমাদের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে। আমরা মাজহাব এবং দ্বীনের মধ্যে এমনভাবে একাকার করে ফেলেছি যে আমরা এদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারছি না। ফলে মাজহাবটাকে আমরা দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে নিচ্ছি। ফলে এ বিভ্রান্তি ও প্রশ্ন আমাদের সামনে উত্থাপিত হচ্ছে।
এখানে কথা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্যই আমাদের জন্য ফরজ করা হয়েছে। আমাদের যে আনুগত্যের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, তা কোরআনে কারিমের মধ্যে সূরা মুহাম্মাদে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো। আল্লাহ এবং তার রাসূলের আনুগত্য যদি তোমরা পরিহার করো, তাহলে তোমাদের আমলগুলো বরবাদ হয়ে যাবে, তোমাদের আমল নষ্ট হয়ে যাবে। তাই তোমরা তোমাদের আমলগুলো নষ্ট করো না।’
এ দুই আমলই মূলত আমাদের করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমরা এই দুটি আমলের জন্যই নির্দেশিত। এ ছাড়া দুনিয়ায় কোনো ব্যক্তির আনুগত্য বা অন্ধ অনুসরণের নির্দেশ রাসূল (সা.) আমাদের দেননি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। তা হলো এই—দুটি হাদিস পাওয়া যায়, একটি হাদিসের মধ্যে তিনি বলেছেন যে, ‘আমার পরে তোমাদের মধ্যে যদি কেউ জীবিত থাকে, অচিরেই সে দেখতে পাবে অনেক মতপার্থক্য।’
তাহলে বোঝা গেল যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এ বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, একটি সময় আসবে, যে সময়ে রাসূলের (সা.) তিরোধানের পর মানুষের মধ্যে অনেক মতপার্থক্য বিরাজ করবে। এ মতপার্থক্য ইসলাম নিয়ে, অন্য বিষয় নিয়ে নয়। ইসলাম নিয়ে, ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান নিয়ে। ইসলামে যে বিধিবিধান আছে, সেগুলো নিয়ে অনেক মতপার্থক্য বিরাজ করবে।
এই হাদিসের মধ্যে স্পষ্ট করে নির্দেশনা দিয়েছেন যে, যখন তোমরা এখতেলাফ দেখতে পাবে, তখন তোমাদের করণীয় কাজ হবে দুটি। একটা হচ্ছে তোমরা আমার সুন্নতকে আঁকড়ে ধরবে। তো, আমার সুন্নতকে আঁকড়ে ধরতে গেলে এ নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হতে পারে। কারণ, আমার সুন্নত নিয়ে পরবর্তী সময়ে মানুষ এখতেলাফ করে ফেলতে পারে। সে জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) সঙ্গে আরেকটি নির্দেশনা দিলেন, যাতে করে আমরা রাসূলুল্লাহর (সা.) সুন্নত থেকে বিচ্যুত না হই। এবং আমার পরবর্তী হেদায়েতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদিনের যে সুন্নাহ আছে, সেগুলো তোমরা অনুসরণ করবে; তারা যেভাবে চলেছে, যে রীতিনীতির অনুসরণ করেছে।
এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, তা হলো, এখানে সুন্নাহ বলতে একটি সিস্টেমকে বোঝানো হয়েছে। কর্মপদ্ধতি ও কর্মনীতিকে বোঝানো হয়েছে। সুন্নাহ বলতে সুন্নতের যে পরিভাষা রয়েছে, সেটাকে বোঝানো হচ্ছে না।
তো, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার পরবর্তী যে খোলাফায়ে রাশেদিন আছে, তাদের সুন্নতের অনুসরণ করলেই দেখবে যে আমার সুন্নতের সঙ্গে সরাসরি মিলে যাবে। এবং সেখানেই মূলত পথভ্রষ্টতা থেকে বাঁচার সুযোগ তৈরি হবে।
যখন এই এখতেলাফ শুরু হলো, এখতেলাফের একটা দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে, যা আজকের এই আলোচনায় শেষ করা সম্ভব নয়। সেই এখতেলাফের ক্ষেত্রে ওলামায়ে কেরাম দেখেছেন যে, সুন্নাহর বক্তব্যের মধ্যে জাল হাদিস, ভুল হাদিস, মিথ্যা হাদিস, অগ্রহণযোগ্য হাদিস, বিচ্ছিন্ন হাদিসের মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং মানুষ সেগুলো গ্রহণ করে নিচ্ছে। ফলে যেটি হয়েছে সেটি হলো ওলামায়ে কেরাম এগুলোকে আরো ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করার জন্য গবেষণার আশ্রয় নিয়েছেন। সুন্নাহর ক্ষেত্রে, সুন্নাহর বক্তব্যের ক্ষেত্রে, সুন্নাহর বর্ণনার ক্ষেত্রে এবং সুন্নাহর যে লিখিত বর্ণনা আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে। এই গবেষণার পরবর্তী যে আকার সেটি হচ্ছে মূলত ওলামায়ে কেরামের মতামত, গবেষণার পর তাঁরা একটি মতামত দিয়েছেন। সেটাকেই বলা হয় মাজহাব। এটা হচ্ছে স্কুল অব থট। এটা গবেষণারই একটি অংশ এবং গবেষণার পরেই এটা ওলামায়ে কেরামের ব্যক্তিগত মত। এটি কোনো দ্বীন নয় এবং এটা কোনো ইসলামের বিধান নয়।
এখন আমরা আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকেই যদি সামনে রাখি, এখানে আমরা অধিকাংশ মানুষই হানাফি মাজহাবের অনুসরণ করে থাকি। অর্থাৎ ইমাম আবু হানিফার অনুসরণ করে থাকি। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রা.) নিজেও বলেন নাই যে, আমার বক্তব্যই তোমাদের জন্য দ্বীন এবং আমার বক্তব্য অনুসরণ করা তোমাদের জন্য ফরজ।
এখন সমস্যা যেটা হয়েছে সেটা হলো এই—যেটা আল্লাহতায়ালা আমাদের ওপর ফরজ করেন নাই, নবী করিম (সা.) আমাদের জন্য ফরজ করেন নাই, আবু হানিফা (রা.) আমাদের জন্য ফরজ করেন নাই সেটাকে আমরা নিজেদের ওপর ফরজ করে নিয়ে, দ্বীন বানিয়ে নিয়ে, অন্ধ অনুসরণ করে থাকি। এবং রাসূলের (সা.) বক্তব্যের ওপর আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না।
ভক্তদের মধ্যে এমন প্রশ্নও অনেকে করে থাকেন, মাজহাব এবং হাদিস দুটোই পাওয়া গেলে আমরা কোনটা অনুসরণ করব। আমরা কি হাদিসের অনুসরণ করব, নাকি আমাদের ইমাম হানিফার (রা.) অনুসরণ করব?
ফলে আমরা বড় ধরনের একটা ভুলের মধ্যে রয়েছি, বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছি। ভুলটি হচ্ছে এই—মাজহাবকে মাজহাবের মর্যাদায় না রেখে আমরা তাকে দ্বীনের মর্যাদায় নিয়ে গেছি। তাই এই ভাই আমাদের এই প্রশ্ন করেছেন যে, রাসূল (সা.) কি আমাদের চার ধরনের নামাজ আদায় করতে বলেছেন?
না, কখনোই না। রাসূল (সা.) আমাদের যে সালাত শিক্ষা দিয়েছেন, ওহির মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রদত্ত বাণীর মাধ্যমে এই জ্ঞান দিয়েছেন। সুতরাং সেখানে দ্বিমত থাকার কোনো সুযোগ নেই। সেখানে দ্বিমত ছিল না। দ্বিমত পরে তৈরি হয়েছে। এ বক্তব্যগুলো পরে যুক্ত হয়েছে। এখানে যে চারটি বা পাঁচটি মাজহাবের কথা এসেছে এবং পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৮ থেকে ১০টি মাজহাবের বিস্তার রয়েছে। এবং এদের যে অনুসারী আছে, তারা যদি এটাকে নিজেদের ওপর ফরজ করে নেন, তিনি কিন্তু পথভ্রষ্ট এবং তিনি ভুল করছেন। তিনি যদি এটা মনে করেন যে, এটা ওলামায়ে কেরামের বক্তব্য, তাঁরা আমাদের কাজকে সহজ করার জন্য আমাদের এই নির্দেশনা দিয়েছেন এবং সেটা মনে করে যদি তিনি তা গ্রহণ করেন, তাহলে তিনি পথভ্রষ্ট হবেন না এবং সেটি গ্রহণ করতেও কোনো আপত্তি নেই।