ঈদুল আজহা ও ঈদুল গাদির
ঈদুল আজহা বা ঈদুল আদহা শিয়া সম্প্রদায় কী চোখে দেখে? অন্য কোথাও না হলেও ভারত-পাকিস্তানের শিয়া মুসলমানদের মধ্যে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আদহা পালনের ব্যাপারে, একটু ইংরেজিতে যাকে বলে ‘রিজার্ভেশন’ আছে। বিশেষ করে ঈদুল আদহা পালনের ব্যাপারে। এতে ‘রিজনিং’ বা ‘আর্গুমেন্ট’টা কম, অভিমানটাই যেন বেশি। তাদের বক্তব্য হলো, ঈদুল আদহা পালিত হয় ১০ থেকে ১৩ জিলহজ। এর মাত্র কিছুদিন পরেই হজরত মুসলিমের শহীদ হওয়ার ও কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা (১০ মহরম) স্মরণের বার্ষিকী অনুষ্ঠান এসে পড়ে। অন্যদিকে, ইমাম হাসান আল-আশকারি শহীদ হন ৮ রবিউল আউয়াল (শিয়ামতে তাঁদের ১১তম ইমামকে গৃহবন্দি অবস্থায় বিষ খাওয়ানো হয়)। এবং কারবালা উপলক্ষে দুই মাস শোক যাপন করার পর শিয়ারা ঈদ-এ-যাহরা উৎসবে যোগ দেয়। ইমাম আল তাকী আল-জাওয়াদ (নবম ইমাম) ২৯ জিলকদ তারিখে শহীদ হন। এ ছাড়া হজরত মুসলিমের ছেলেরাও শহীদ হন ২২ জিলহজ। তার পর এবং ঈদ-এ-মুবাহিলা (নাজরান-এ খ্রিস্টানদের ওপর মুসলিমদের জয়) পড়ে ২৪ জিলহজ। খুব কাছাকাছি এতগুলো ঈদ থাকতে, বিশেষ করে ঈদুল আদহার ওপর তাহলে কেন অত গুরুত্ব দেওয়া হবে? তাই অন্তত ঈদুল আদহার বেলায় তারা নাকি কেবল নামাজটাই পড়ে, সেলিব্রেট বা উদযাপন করে না। অনেকে হয়তো আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। একে অপরের বাড়িতে যায়, খাওয়া-দাওয়া করে, আর বাকি সময়টা ‘আমল’ করে।
সৌভাগ্যবশত, এদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এদের বাদ দিলে বাকি শিয়াদের মতামত হলো, ইসলাম তাদের বলে না, দুঃখ-দুর্দশা আছে বলে সব সময় তাদের মন খারাপ করে বসে থাকতে হবে। তাদের তরুণ সম্প্রদায় এটাকে নিয়ে চিরকাল চলতে পারে না, বরং এভাবে চলতে থাকলে একসময় তারা বিরক্ত হয়ে ইসলাম ছেড়ে চলে যাবে। আহলে বায়েতের ব্যথা-বেদনা, শোচনীয় ভোগান্তি ও পরিণতি নিয়ে কান্নাকাটি করে সবকিছু ভাসিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সেই মানুষগুলোকে প্রকৃত সম্মান দিতে হলে তাদের সততা, ত্যাগ, সাহসিকতা, বীরত্ব, একনিষ্ঠতা এবং প্রয়োজনে জীবন দিয়েও কীভাবে তাঁরা তাদের আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন, সেই শিক্ষা নেওয়া ও অনুসরণ করাটা অনেক বাস্তব।
ঈদুল গাদিরটা (ঈদ আল-গাদির) আসলে কী? শিয়া মুসলমানরা ১৮ জিলহজ তারিখে ঈদ আল-গাদির উৎসব পালন করে। শিয়াদের মতে, ওই দিন নাকি রাসূল (সা.) তাঁর চাচাতো ভাই হজরত আলী ইবনে আবু তালিবকে তাঁর উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করেন। এই দিনটি ‘খুম্ম জলাশয়’-এর হাদিসে বর্ণিত মহানবীর ইন্তেকালের আগে তাঁর উম্মাহকে দেওয়া শেষ ভাষণ বার্ষিকী দিবস হিসেবেও পালন করা হয়। প্রসঙ্গত, ‘খুম্ম জলাশয়’-এর বর্তমান নাম ‘আল-জোহফা’। এই হাদিস অনুযায়ী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যিনি আমার রক্ষক, তিনি আলীরও রক্ষক। ও আল্লাহ, যারা তাকে ভালোবাসে, তুমি তাদের অনুগ্রহ করো, যারা তার প্রতি বিরূপ হয়, তুমি তাদের প্রতি বিরূপ থাক।’ শিয়ারা প্রতিবছর এই দিনটাতে সমবেত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামের প্রতি তাদের দৃঢ় বিশ্বাসের ওপর নতুন করে শপথ নেয়, ঠিক যেমনভাবে প্রতিটা শিয়া সাবালক হওয়ার পর ব্যক্তিগতভাবে ইসলামের প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্যের শপথ নেয়।
সুন্নি মুসলমানরা ঈদুল গাদির পালন করে না। এর প্রথম কারণ হলো, তারা মনে করে, এটা আগে উদযাপন করার জন্য প্রতিষ্ঠিত কোনো দিন ছিল না। সুন্নিদের বিশ্বাস, আল্লাহতায়ালা কোরআনের সূরা (৫-৩)-এ বলেছেন, ‘আজ এই দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ রূপ দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম। কাজেই পারফেকটেড বা পূর্ণতা প্রাপ্তি তো হয়ে গেছে। আর একটা ঈদ যোগ করলে একটা সম্পূর্ণকে আরো সম্পূর্ণ করা যায় না, বরং তা অসম্পূর্ণ বা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
আর রাসূলুল্লাহর (সা.) ইন্তেকালের কয়েক মাস আগে যখন তিনি মদিনা থেকে মক্কায় শেষবার বিদায় হজ করে ফিরছিলেন, সে সময় তিনি পথে আরাফাত পাহাড়ের শীর্ষে উপস্থিত মুসলিম জনতার উদ্দেশে এক ভাষণ দেন। এটাই সেই বিখ্যাত ‘বিদায় ভাষণ’। ‘সহি মুসলিম’ হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, হজরত মুহাম্মদ (সা.) হজরত আলীকে পরবর্তী ‘মাওলা’ হিসেবে মনোনীত করেন এবং সমবেত জনতাকে সেটা মেনে নেওয়ার জন্য আদেশ করেন। ‘মাওলা’র ইংরেজি তর্জমা হলো মাস্টার (Master), যেটার বাংলা হলো হুকুমদাতা, নিয়ন্ত্রণকারী, প্রভু, মালিক, নায়ক, সর্দার, কর্তা, পূর্ণ দক্ষতাপূর্ণ ব্যক্তি ইত্যাদি। ইসলামের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে এই ‘মাওলা’ কথাটার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। শিয়াদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এ ঘোষণায় আলীকে পরিষ্কারভাবে হজরতের উত্তরসূরি বলে মনোনীত করা হয়েছে। সুন্নিদের ব্যাখ্যা হলো, হজরত আলীর সঙ্গী-সাথিদের সামনে ও জনতার সামনে তাকে প্রকাশ্যে প্রশংসা করার জন্য ওভাবে বলা হয়েছে। তার কারণ হজরত আলীকে সে সময় জনগণের বেশির ভাগ পছন্দ করলেও অনেকেই পছন্দ করত না। তাই সবাইকে পছন্দ করা ও মেনে চলার জন্য আদেশটা ওভাবেই দেওয়া হয়েছিল।
আসলে শিয়া-সুন্নির মধ্যে তফাৎটা কী ও কতটা?
মূল ধর্মের দিক থেকে বলতে গেলে তেমন বড় কিছুই নয়। কিছুটা মতভেদ অবশ্যই আছে। আসল কারণটা মূলত রাজনৈতিক। ক্রমবর্ধমান এই ইসলামিক কমিউনিটির (উম্মাহ) শাসনভার কার বা কোন গ্রুপের হাতে ন্যস্ত হবে, এ নিয়েই রেষারেষি। রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো পুত্রসন্তান রেখে যাননি। সে জন্য একটা গ্রুপ (যারা ভবিষ্যতে সুন্নি বলে পরিচিত হবে) চেয়েছে, পরবর্তী নেতা হতে তাঁর নিজের কোরাইশ বংশ থেকে সবার পছন্দ ও যোগ্যতাসম্পন্ন কেউ হাল ধরুক। অন্য গ্রুপ (যারা ভবিষ্যতে শিয়া বলে পরিচিত হবে) চেয়েছে, পরবর্তী নেতা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে রক্তের সম্পর্কের কেউ হবে। তার ওপর তারা রাসূলুল্লাহর (সা.) বিদায় বাণীর মধ্যে হজরত আলী সম্পর্কে মন্তব্যকে তুলে ধরে। বিবাদটা অনেকটা খ্রিস্টান ধর্মের ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্টদের বিভেদের মতো। তফাৎটা হলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ওদের হানাহানি-কাটাকাটি চললেও এখন সেটা অন্তত শত্রুতার পর্যায়ে আর নেই। তাদের মিলেমিশে থাকার তাগিদ আছে। অথচ আমাদের এক পক্ষ অন্যকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত যেন শান্তি পাচ্ছে না। এবং তা বেড়েই চলেছে।
এবার মিলের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আসল তফাৎগুলো কোন কোন বিষয়ে বা ক্ষেত্রে, তা একটু পর্যালোচনা করে দেখা যাক :
১) জনসংখ্যা—শিয়া ২৪০ মিলিয়ন (২ দশমিক ৪ কোটি), সুন্নি ১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন (১৩৬ কোটি)।
২) মুহাম্মদ (সা) হজরত আলীকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন। শিয়া মত—অবশ্যই। সুন্নি মত—ব্যাপারটা তা নয়।
৩) শাসক বা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার যোগ্যতা নির্ণয় বা বিচার :
শিয়া—অবশ্যই হজরত ফাতেমা, আলীর বংশোদ্ভূত এবং একজন পুত্রসন্তান হতে হবে।
সুন্নি—মুসলিম জনসাধারণ (উম্মাহ) একমত হয়ে, ইসলামের রীতিনীতি ঠিকমতো অনুসরণকারীদের মধ্য থেকে যোগ্য মনে হয়, এমন কাউকে তারা পছন্দ করে নিতে পারে।
৪) হজরত মুহাম্মদের(সা.) উত্তরাধিকারী পরম্পরা :
শিয়া—কখনো ভুল/পাপ করতে পারেন না। এমন ১২ জন ইমাম হলেন আলী বিন আবু তালিব, হাসান, হোসেন, আলি জয়নুল আবেদিন, মোহাম্মদ আল বাকির, জাফর আল সাদিক, মুসা আল কাজিম, আলী আল রাজা, মোহাম্মদ আল তাকী, আলী আল নাকী, হাসান আল আসকারী, মোহাম্মদ আল মাহাদি।
সুন্নি—সত্যপথে নির্দেশিত চারজন খলিফা (খোলাফায়ে রাশেদিন)। তাঁরা হলেন হজরত আবু বকর, উমর বিন আল খাত্তাব, উসমান বিন আফফান, আলী বিন আবু তালিব।
৫) ইমাম সম্পর্কে ধারণা ও মতামত :
শিয়া—যাঁরা স্বর্গীয় নির্দেশপ্রাপ্ত, কেবল তাঁদের দেওয়া কোরআনের ব্যাখ্যাই বৈধ।
সুন্নি—ইমামরা পবিত্র ব্যক্তি, সাধুসন্ত, যাঁদের কোরআন ও সুন্নাহর ওপর শক্ত বিশ্বাস আছে।
৬) প্রত্যাদেশ (অহি) পাওয়ার অধিকারী ও তাদের পরম্পরা চলতে থাকার মেয়াদ :
শিয়া—ইমামরা স্বর্গীয় নির্দেশপ্রাপ্ত। তাঁদের কাজই হচ্ছে ধর্মকে সংরক্ষণ করা ও তার গূঢ় রহস্য ব্যাখ্যা করা।
সুন্নি—একেবারেই না। স্বর্গীয় জ্ঞ্যান ও প্রত্যাদেশ পাওয়ার অধ্যায় হজরত মুহাম্মদের (সা.) ইন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে।
৭) ১০ মহরম নিজেকে বেত্রাঘাত, বুক চাপড়ানো, ছুরি, চাকু বা চেনের আঘাতে রক্তপাত করা :
শিয়া—শহীদ হোসেনের মৃত্যু উপলক্ষে তাঁকে স্মরণ ও প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত।
সুন্নি—না। ওভাবে পালন করা একটা গুনাহ (পাপ)-এর কাজ।
৮) পবিত্র স্থান, তীর্থ ও মাজার বানানোর অনুমতি :
শিয়া—হ্যাঁ আছে। সুন্নি—না নেই (যদিও কিছু সুন্নি মাজার আছে)।
৯) ফেরেশতাদের ব্যাপারে মতামত :
শিয়া—তারা আল্লাহর আদেশ মেনে চলে। সীমিতভাবে তাদের নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছায় চলার অধিকার আছে। তবে তারা পাপ কাজের দিকে যায় না।
সুন্নি—ফেরেশতারা আলো থেকে সৃষ্ট। তাদের নিজেদের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই। তারা কেবল আল্লাহর আদেশ মেনে চলে।
১০) ইসলাম থেকে উদ্ভূত কোনো প্রকার প্রশাখা : শিয়া—বাহাই, সুন্নি—আহমাদিয়া
১১) কী কী উৎসব পালন করা হয় : শিয়া—আশুরা, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আদহা, ঈদুল গাদির।
সুন্নি—ঈদুল ফিতর, ঈদুল আদহা, ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী (সা.)
১২) ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত প্রধান প্রধান স্থান : শিয়া—কুফা, কারবালা। সুন্নি—মক্কা, মদিনা।
১৩) ধর্মে বিশ্বাসী প্রধান প্রধান দেশ : শিয়া—ইরাক, ইরান, ইয়েমেন, বাহরাইন, লেবানন, আজারবাইজান। নানা দেশের সংখ্যালঘু।
সুন্নি—প্রায় সব মুসলিম দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা। পৃথিবীর বাকি প্রায় সব দেশের সংখ্যালঘু।
১৪) বিশ্বাসের ভিত্তিসমূহ : শিয়া—১) নামাজ, ২) রোজা, ৩) হজ, ৪) জাকাত (২০% ইমাম ও গরিবদের জন্য), ৫) জিহাদ। ৬) ভালোকে উন্নীত করা, ৭) খারাপের সংসর্গ ছাড়া, ৮) বার্ষিক আনুগত্য প্রকাশ ও ৯) প্রথম খলিফা থেকে আরম্ভ করে ইসলামের সব শত্রুর সঙ্গ ও সখ্য বর্জন।
সুন্নি—১) ইমান, ২) নামাজ, ৩) জাকাত (২.৫%), ৪) রোজা, ৫) হজ, ৬) আল্লাহর রাস্তায় চলা, শিষ্টকে লালন ও দুষ্টকে দমন।
১৫) বিনা ঘোষণায় সাময়িক বিয়ে : শিয়া—হ্যাঁ, শুদ্ধ। সুন্নি—না। সেটা ব্যভিচার বলে গণ্য হবে।
১৬) ইমাম ও মুজতাহিদদের মুখে মুখে প্রচলিত ধর্মীয় নানা কথা ও আলোচনা সংগ্রহকারীগণ:
শিয়া—১) নাহাজুল বালাঘা, ২) কিতাব আল-কাফি, ৩) মান লা ইয়াহদুরুহু আল ফাকিহ, ৪) তাহদিব আল আহকাম, ৫) আল ইসতিবসার।
সুন্নি—১) মুয়াত্তা মালিক, ২) মসনদ আহমেদ, ৩) সহিহ বুখারি, ৪) সহিহ মুসলিম, ৫) সুনান আবু দাউদ, ৬) জামী আল তিরমিদী, ৭) সুনান নাসায়ী।