অমিতের নাম বলেননি আবরারের বাবা, জেরাও হয়নি
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ রাব্বী (২২) হত্যা মামলায় ২৫ আসামির বিরুদ্ধে আজ মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
আজ ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের আদালতে দ্বিতীয় দিনের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। সাক্ষ্য গ্রহণের শুরুতে অন্যতম আসামি বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহার পক্ষে জেরা করতে আইনজীবীকে বলেন বিচারক।
তবে অমিত সাহার আইনজীবী মুনজুর আলম নিহত আবরারের বাবা মো. বরকত উল্লাহকে জেরা করতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। তিনি আবরারের বাবাকে জেরা করতে অস্বীকার (ডিকলাইন) ঘোষণা করেন। ফলে আবরারের বাবাকে জেরা ছাড়াই অমিত সাহার পক্ষে জেরা শেষ হয়।
এ বিষয়ে অমিত সাহার আইনজীবী মুনজুর আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘নিহত আবরারের বাবা তাঁর দাখিলকৃত এজাহার ও সাক্ষীর জবানবন্দিতে অমিত সাহার নাম বলেননি। তাই আমরা অমিত সাহার পক্ষে জেরা করিনি। সাক্ষীকে (আবরারের বাবা) আমরা জেরা করতে অস্বীকার (ডিকলাইন) করেছি।’
এদিকে সাক্ষ্য গ্রহণের কার্যক্রম আজও শেষ না হওয়ায় বিচারক আগামীকাল আবারও সাক্ষীর দিন ধার্য করেছেন।
এর আগে গতকাল আদালতে আবরারের বাবা মো. বরকত উল্লাহ সাক্ষ্য দেন এবং পরে জেরা শুরু হয়।
গত বছরের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের একটি কক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেন। এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরের দিন ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন আবরারের বাবা।
মামলার ২৫ আসামি
মামলায় আসামিরা হলেন—বুয়েট ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহতামিম ফুয়াদ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মো. অনিক সরকার ওরফে অপু, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন ওরফে শান্ত, আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা, উপসমাজসেবাবিষয়ক সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, ক্রীড়া সম্পাদক মো. মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, গ্রন্থ ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক ইশতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, কর্মী মুনতাসির আল জেমি, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, মো. মুজাহিদুর রহমান, মো. মনিরুজ্জামান মনির, আকাশ হোসেন, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, মো. মাজেদুর রহমান মাজেদ, শামীম বিল্লাহ, মুয়াজ ওরফে আবু হুরায়রা, এ এস এম নাজমুস সাদাত, আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান, শামসুল আরেফিন রাফাত, মোর্শেদ অমত্য ইসলাম, এস এম মাহমুদ সেতু, মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল ওরফে জিসান, এহতেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম ও মুজতবা রাফিদ।
আসামিদের মধ্যে মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল ওরফে জিসান, এহতেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম ও মুজতবা রাফিদ পলাতক। বাকি ২২ জন গ্রেপ্তার আছেন। এ মামলায় আটজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
মামলার বিবরণ
গত বছরের ১৩ নভেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. ওয়াহিদুজ্জামান ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এরপর এ বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি এ মামলার বিচারকাজ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর জন্য ঢাকার মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটরের (পিপি) কার্যালয়ে আবেদন করেন নিহত আবরার ফাহাদের বাবা মো. বরকত উল্লাহ। ১২ মার্চ আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক আবরার হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর ফাইল অনুমোদন করেন।
কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় মামলার বিচারকাজ বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকে।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর এ মামলায় অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন আদালত এবং বিরতিহীন সাক্ষ্যগ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর অংশ গত ২০ সেপ্টেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু বাদী আবরারের বাবা মো. বরকত উল্লাহ জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ থাকায় ওই সময় সাক্ষ্য দিতে পারবেন না বলে সময়ের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য গতকাল সোমবার দিন রেখেছিলেন।
সাক্ষ্যে যা বললেন আবরারের বাবা
সাক্ষ্য গ্রহণের প্রথমদিনে আবরারের বাবা মো. বরকত উল্লাহ জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমি কাশফুল নামের একটি এনজিওতে চাকরি করি। আমার ছেলে আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। আমি লোক মারফত জানতে পারি,বুয়েটের হলে কতিপয় ছাত্র আমার ছেলেকে (আবরার) পূর্ব পরিকল্পিতভাবে মারধর করে হত্যা করেছে। সেই সংবাদ পেয়ে আমি তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় আসি। ঢাকায় এসে হল কর্তৃপক্ষ,ছাত্র ও শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করি এবং সিসিটিভিতে ধারণকৃত ছবি থেকে জানতে পারি- হলের ছাত্র আসামি মেহেদী হাসান রাসেল,মুহতামিম ফুহাদ, মো. অনিক সরকার,মেহেদী হাসান রবিন ওরফে শান্ত,ইফতি মোশাররফ সকাল,মো. মনিরুজ্জামান মনির, মাজেদুর রহমান, মো. মাজেদুল ইসলাম, মোহাম্মদ মুজাহিদুল, মো. তানভীর রহমান, হোসেন মোহাম্মদ ফাহাদ, মো. জিসান, মো. আকাশ, মো. শামীম বিল্লাহ, মো. সাদাত, মো. তানিম, মো. মোর্শেদ, মো. ফুয়াদ, জেমিসহ অজ্ঞাত পরিচয় আরো কয়েকজন বুয়েটের ছাত্র ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাত অনুমান ৮টা ৫ মিনিটে আমার ছেলেকে আবাসিক হলে রুম নং ১০১১ হতে হত্যার উদ্দেশ্যে ডেকে নিয়ে যায় এবং ওই বছরের ৭ অক্টোবর রাত অনুমান ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত হলের রুম নং ২০১১ এবং ২০০৫ এর ভিতর নিয়ে পূর্বপরিকল্পিতভাবে স্ট্যাম্প, লাঠি, রশি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রচণ্ডভাবে মারধর করে, যার ফলে ঘটনার স্থানেই আমার ছেলে মারা যায়।’
জবানবন্দিতে আবরারে বাবা আরো বলেন, ‘ছেলেরা হলের দ্বিতীয় তলায় মৃতদেহ ফেলে রাখে,পরে কতিপয় ছাত্র আমার ছেলের মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। তখন ডাক্তার আমার ছেলেকে মৃত ঘোষণা করেন। আমি ঢাকায় পৌঁছে হলের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে,হলের কতিপয় ছাত্র ও শিক্ষকের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ, সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে এবং আমার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এজাহার দায়ের করি। পূর্বশত্রুতার জেরে পরস্পর সহযোগে আসামিরা আমার ছেলে আবরার ফাহাদ রাব্বীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আমি চকবাজার থানায় মামলা করি। থানা থেকে ছাড়পত্র নিয়ে আমার ছেলের লাশ কুষ্টিয়ার উদ্দেশে নেওয়ায় জন্য ঢাকা মেডিকেল মর্গে যাই এবং লাশ গ্রহণ করি।’
তারপর ৭ অক্টোবর তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে রাত ১০টা ২০ মিনিটে ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে গিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা বুয়েটের অফিস থেকে দুটি সিসিটিভি ক্যামেরা, ডিভিআর জব্দ করেন। সে সময় সাক্ষী হিসেবে আমার সঙ্গে আমার স্বজন ওয়াদুর রাফসান ও ওয়াহিদ উপস্থিত ছিল।
তারপর সেখানে থেকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর এবং ২০১১, ২০০৫ নম্বর রুম এবং দ্বিতীয় তলায় উঠার সিঁড়িতে উঠি। পরে তদন্ত কর্মকর্তাসহ যে স্থানে আবরারের লাশ পড়ে ছিল সেখানে গিয়ে ঘটনার স্থান শনাক্ত করি। পরবর্তী সময়ে তদন্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে জানতে পারি, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ইফাত মোশাররাফ, অনিক সরকার, মেহেদী হাসান, মনিরুজ্জামান, মিফতাউল ইসলাম, মো. মুজাহিদ,খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, সাদাতকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি জানতে পারি, গ্রেপ্তার হওয়া চার আসামি আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করে এবং সব আসামি আমার ছেলেকে কীভাবে হত্যা করেছে, তার বর্ণনা দিয়েছে।’
আবরারের বাবা মো. বরকত উল্লাহ বলেন, ‘আসামিদের জবানবন্দি ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের মাধ্যমে ঘটনার পূর্বপরিকল্পিত মতে আসামিরা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। আমি আমার ছেলের হত্যার ন্যায়বিচার চাই। আসামিরা প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে অমানুষিকভাবে শারীরিক নির্যাতন করে পরিকল্পিতভাবে আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। এই আমার জবানবন্দি। ’