করোনায় পর্যুদস্ত মেলবোর্ন
অস্ট্রেলিয়ায় মেলবোর্নকে বলা হয় দেশটির শিক্ষানগরী। মনাশ, ইউনি মেলবোর্ন, আরএমআইটিসহ ছোট-বড় বেশ কয়েকটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এই নগরীতে, যাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই লাখ ৭৭ হাজার। যার মধ্যে ৯১ হাজার শিক্ষার্থী পড়তে আসেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, নেপালের শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য চোখে পড়ে।
উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছেলেমেয়েরা পড়তে আসেন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ খণ্ডকালীন কাজ করে শিক্ষার বিশাল খরচ মেটানোর চেষ্টা করেন। সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজের বৈধ সুযোগ পান শিক্ষার্থীরা। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রকোপে মেলবোর্নে চলা লকডাউনের কারণে অনেক শিক্ষার্থী হারিয়েছেন কাজ। জীবন চালাতে অনেকেই হিমশিম খাচ্ছেন। শিক্ষার্থী ছাড়াও এই নগরীতে চাকরি হারিয়েছেন লাখো মানুষ। চিরচেনা উৎফুল্ল মেলবোর্নের মানুষ করোনায় হয়েছেন পর্যুদস্ত। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে নগরীতে চলতে থাকা লকডাউনের কারণে মেলবোর্নের সবখানে এখন শূন্যতা।
এ বছরের শুরুতে সারা দুনিয়ায় যখন লাখ লাখ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছিলেন, হাজার হাজার মৃত্যুতে মুষড়ে পড়ছিল মানুষ, তখনো অস্ট্রেলিয়ার বড় বড় শহরের মানুষ ছিলেন স্বস্তিতে। বছরের শুরুতে প্রমোদতরীতে ঘুরতে যাওয়া মানুষের মাধ্যমে সিডনিতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকার আর মানুষের সতর্কতায় নিয়ন্ত্রণে চলে আসে আক্রান্তের সংখ্যা। তখনো মেলবোর্নে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল নিয়ন্ত্রণে।
দুই কোটি মানুষের এ বিশাল দেশে করোনায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৮৯৯ জন, যাঁদের বেশির ভাগই বয়স্ক মানুষ, যাঁরা বাস করতেন বৃদ্ধনিবাসে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ২৭ হাজার ৩১৭ জন। যাঁদের মধ্যে ২০ হাজার ৩০৫ জনই মেলবোর্নের বাসিন্দা। আর মেলবোর্ন নগরীতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮০০-এর বেশি মানুষ। তবে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা এখন পড়তির দিকে।
অস্ট্রেলিয়ার এ শিক্ষানগরীতে করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কা মোটামুটি সামলে নিলেও জুলাইয়ে মার্কিন মুলুকে ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার্স’ আন্দোলনের ঢেউ অস্ট্রেলিয়ায় এসে পড়লে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। এর মাঝে কোরবানির ঈদের পরপরই সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা আচমকা বাড়তে শুরু করে। সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা দৈনিক সাতশয় পৌঁছায়। করোনায় মৃতের সংখ্যাও বাড়তে থাকে হু হু করে।
উপায়ান্তর না দেখে পরিস্থিতি সামাল দিতে ২ আগস্ট ভিক্টোরিয়া রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ড্যানিয়েল অ্যান্ড্রুজ রাজ্যে লকডাউন ঘোষণা করেন। রাতে কারফিউ জারি হয়। শর্ত দেওয়া হয়, দিনে জরুরি বাজার-সদাই করতে পরিবারের একজন বাসা থেকে বের পারবেন, পরিবারের সবাই মিলে কোথাও যাওয়া যাবে না, ব্যায়ামের জন্য এক ঘণ্টা, পাঁচ কিলোমিটারের বেশি দূর যাওয়া যাবে না।
দেড় মাস এমন অবস্থায় চলার পর পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি হলেও সন্তোষজনক না হওয়ায় অক্টোবরের শুরুতে লকডাউন বেড়ে যায় আরো দুই সপ্তাহ। যদিও রাত্রিকালীন কারফিউ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তে খানিকটা হলেও স্বস্তি আসে। সেইসঙ্গে স্কুল খুলে যাওয়ায় আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে চলা শিশুদের ঘরে বসে স্কুল করা দমবন্ধ জীবনেও আনন্দের ঢেউ লাগে।
সবশেষ বর্ধিত দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলে মেলবোর্নে করোনা-সংক্রমণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা যায়। ১৭ অক্টোবরে গোটা রাজ্যে মাত্র একজন ও ১৮ অক্টোবর দুজনের শরীরে নতুন করে সংক্রমণ ধরা পড়ে। এ দুদিনে কারো মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেনি। পরিস্থিতিকে অন্তত আশাজাগানিয়া উল্লেখ করে লকডাউনের নানা বিধিনিষেধ শিথিলের ঘোষণা দেন রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। ১৮ অক্টোবর রাজ্যের প্রিমিয়ার ঘোষণা দেন, পাঁচ কিলোমিটারের বদলে ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ভ্রমণে কোনো বিধিনিষেধ থাকছে না। টেনিস কোর্ট, গলফ কোর্ট খুলে যাবে। ব্যায়াম করতে যাওয়ার ঘণ্টাওয়ারি কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকছে না।
আরো আশার খবর। মাস তিনেক ধরে সেলুন বন্ধ থাকায় যাঁরা বাবরি চুলে বাউল হয়েছিলেন, তাঁরা অবশেষে নরসুন্দরের কাছে যেতে পারবেন। কারণ, সেলুন খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে পুরোনো চেহারায় ফিরতে আর কোনো বাধা থাকছে না। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা আর খাবার দোকান ছাড়া অন্য কোনো দোকানপাট খোলার সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের স্বস্তি ফেরেনি।
লকডাউন অনেকটা শিথিল হলেও কারো বাসায় গিয়ে এক ছাদের নিচে বসে নিশ্চিন্তে সময় কাটানোর সুযোগটি মুঠোয় রেখে দিয়েছে রাজ্য সরকার। ফলে লকডাউন শিথিল হলেও স্বস্তি ফেরেনি মানুষের। প্রবাসে প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানোর সেই সুযোগের অপেক্ষায় মুখিয়ে আছেন অস্ট্রেলিয়ার এ শিক্ষানগরীর ৫৫ লাখ মানুষ।
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি সন্তোষজনক থাকলে, আসছে নভেম্বরের আগেই মেলবোর্নে সব নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। পুরোনো উৎসবের মেজাজে ফিরতে পারবে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এ নগরীর মানুষ।