ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন মুক্তাগাছা রাজবাড়ি
কাজের চাপে নাকাল হয়ে অনেকেই ছুটে যেতে চান শহর থেকে দূরে কোথাও। সুখবর হলো সামনেই আসছে পূজার ছুটি। এই ছুটিতে চলে যেতে পারেন ময়মনসিংহে। তাই পূজার ছুটিতে আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন ময়মনসিংহে বেড়াতে যাবেন। ময়মনসিংহে প্রথমেই ঘুরবেন কোথায় এই ভাবনাটা মাথায় আসতেই সর্বপ্রথমেই হয়তো আপনার মনে হবে মুক্তাগাছা রাজবাড়ি আগে দেখে ফেলা উচিত।
এর চমৎকার স্থাপত্য দেখে আপনি মুগ্ধ হবেন। মুক্তাগাছা রাজবাড়ি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে।
যা হোক, আপনাকে তাহলে মুক্তাগাছা রাজবাড়ি সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে দিই। ময়মনসিংহ জেলায় যে কয়টি রাজবাড়ি আছে, তার মধ্যে মুক্তাগাছা রাজবাড়ি অন্যতম। ১৭২৫ সালে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য জমিদারিটি প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুর্শিদ কুলি খাঁর কাছ থেকে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য তাঁর কৃতিত্বের পুরস্কার স্বরূপ বিনোদবাড়ির জমিদারি পান। মুক্তাগাছার আগের নাম ছিল বিনোদবাড়ী। এই জমিদারের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বগুড়ার অধিবাসী। জমিদার শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য প্রথম বগুড়া থেকে নৌকাযোগে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে ময়মনসিংহে আসেন। তিনি যে স্থানে অবতরণ করেন, তা রাজাঘাট নামে পরিচিত। রাজা বসবাসের অনুপযুক্ত স্থানকে পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন করেন।
তিনি ময়মনসিংহজুড়ে ১৬ হিস্যার জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তাঁর চার ছেলে যথাক্রমে রাম রাম, হরে রাম, বিষ্ণু ও শিবরাম এবং এঁদের বংশধররা পর্যায়ক্রমে জমিদারি পরিচালনা করেছেন। মুক্তাগাছার এই রাজবাড়ি ছিল হরে রামপুত্র জগৎ কিশোর আচার্য্য চৌধুরীর। তিনি ছিলেন আটানীর জমিদার এবং তৎকালের অন্যতম প্রভাবশালী জমিদার। প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন এই জমিদারবাড়িটি এখন ভগ্নপ্রায়, তবুও সগর্ভে জানান দিয়ে যায় আমাদের ঐতিহ্যকে। বহু বছর কেটে গেছে, মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ি হারিয়েছে আগের সেই ঐশ্বর্য, কোনোভাবে টিকে আছে যেন। রাজবাড়ির সামনে গেলেই চোখে পড়বে ধূসর দরজা। একসময় এই দরজাটিই ছিল সিংহ দরজা, যা সময়ের পরিক্রমায় পরিণত হয়েছে একটি ভগ্ন দরজায়। যখন দরজা পেরিয়ে ভেতরে পা রাখলাম, মনে হলো যেন পৌঁছে গেছি ৩০০ বছর আগের সেই সময়ে। মনে হচ্ছিল আমিই এই রাজবাড়ির রাজা, এখনই এসে কুর্নিশ করবে একদল পাইক-পেয়াদা। কিন্তু ইচ্ছে করলেই কি হয়, রাজা যে এখানে নেই এখন, শুধু এই ভগ্ন বাড়িটা ছাড়া।
যা হোক, রাজবাড়ির মূল ফটক বা সিংহ দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে বেশ কিছু খালি ফোকর। সেখানে ছিল সিমেন্ট, চিনামাটি ও মূল্যবান পাথরে তৈরি সিংহ। রাজপ্রাসাদের আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ফটকের দুই পাশে করিডরের পাশে তিনটি করে মোট ছয়টি সিংহমূর্তি ছিল। সে কারণেই এই ফটকটির নাম ছিল সিংহ দরজা। সিংহ দরজা পেরিয়ে একটু এগোলেই খানিকটা খোলা জায়গা, অনেকটা বাড়ির আঙিনার মতো। আরেকটু এগোলেই চোখে পড়বে একটি মন্দির। এখানে নিয়মমতো পূজা করা হতো। এখানকার কষ্টিপাথরের বিগ্রহ চুরি হয়ে গেছে আগেই, তাই শূন্যই পড়ে আছে পূজামণ্ডপ। পূজামণ্ডপের মেঝে মূল্যবান মার্বেল টাইলস বিছানো ছিল, লোপাট হয়েছে সেগুলোও। এমনকি বাদ যায়নি দরজা-জানালার কপাটও। মন্দির থেকে হাতের ডান পাশেই ফাঁসির ঘর। এখানে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো অপরাধী এবং অবাধ্য প্রজাদের। এই ঘরের সামনে ছিল একটি বড় গর্ত, যা এখন ভরাট অবস্থায় আছে। এই গর্তেই ফেলে দেওয়া হতো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া লাশদের। গর্তের সঙ্গে ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের যোগসূত্র। জোয়ারের পানিতে ভেসে যেত ওই সব মানুষের লাশ।
এই রাজবাড়ির ভেতরে আরো আছে জমিদারের মায়ের ঘর, অতিথি ঘর, সিন্দুক ঘর। এ সিন্দুকের ঘরেই জমিদারের সোনাদানা, টাকা-পয়সাসহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিস জমা থাকত। এখনো সিন্দুকের ভগ্নাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। জমিদার আর তাঁর স্ত্রী থাকতেন দ্বিতল ধরনের একটি বাংলোতে। জমিদার জগৎ কিশোর আচার্য্য চৌধুরী বেশ জ্ঞানচর্চা করতেন। তাঁর ছিল একটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরি, নাম ‘জিতেন্দ্র কিশোর গ্রন্থাগার’। ধারণা করা হয়, ততকালীন পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে বৃহৎ লাইব্রেরি ছিল এটি, বইয়ের সংগ্রহ ছিল প্রায় ১০ হাজারের মতো। তালপাতায় লিখিত পুঁথি থেকে শুরু করে এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকার মতো বহু দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহ ছিল এখানে। কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন সময়ে বইগুলো নষ্ট গেছে, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের সময়। পরবর্তীকালে এই বইগুলো মুক্তাগাছা সংগ্রহ নামে বাংলা একাডেমিতে স্থানান্তর করা হয়। জমিদারের ছোট ছেলে ভূপেন্দ্র ছিল একজন নাট্যপ্রিয় মানুষ। তারই নামানুসারে জমিদার নির্মাণ করেন ‘ভূপেন্দ্র রঙ্গ পীঠ’। এটি একটি ঘূর্ণায়মাণ মঞ্চ ছিল, তবে বর্তমানে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। এত বছর আগে ঘূর্ণায়মাণ রঙ্গমঞ্চের মতো টেকনোলজিক্যাল স্টেজ, যা সত্যিই আমাদের অবাক করে। রাজবাড়ির শেষের দিকের ভেতরবাড়ি পার হলেই একটি ছোট পুকুর ছিল। এখন তা ভরাট হয়ে গেছে। এর পরেই আছে রাজবাড়ির সীমানাপ্রাচীর।
যাতায়াত
রাজধানী ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার জন্য এনা, শৌখিন বা নিরাপদ পরিবহনের বাস পাওয়া যাবে, এদের সবগুলো ভালোমানের এবং আরামদায়ক। ময়মনসিংহ পর্যন্ত যেতে সাধারণত ভাড়া লাগে ২২০-২৫০ টাকা, তবে ঈদের সময় ভাড়া কিছুটা বেশি থাকতে পারে। ময়মনসিংহ পৌঁছাতে সময় লাগবে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। তারপর ময়মনসিংহ শহরে নেমে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল রুটে চলা বাসে উঠতে হবে আপনাকে। মুক্তাগাছার সড়ক ধরে ১০ কিলোমিটার যাওয়ার পর চোখে পড়বে ভগ্নপ্রায় রাজবাড়িটি। বাজারের ভেতর দিয়ে একটু হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন মুক্তাগাছা রাজবাড়ি।
থাকা-খাওয়া
থাকা-খাওয়ার জন্য মুক্তাগাছায় রয়েছে ভালো পরিবেশ। থাকার জন্য বুকিং দিয়ে রাখতে পারেন মুক্তাগাছা উপজেলা শহরের আবাসিক হোটেলে। তা ছাড়া থাকতে পারেন ময়মনসিংহের আবাসিক হোটেলগুলোতেই। মুক্তাগাছা গেলে বিখ্যাত মন্ডা খেতে এবং নিয়ে আসতে ভুলেন না যেন।
অনেকটা সময় মুক্তাগাছা রাজবাড়ির গল্প শুনে আপনার চোখের সামনে জমিদারের মায়ের ঘর, অতিথি ঘর, সিন্দুক ঘরসহ জমিদারের সোনাদানা ও টাকা-পয়সা, অন্যান্য মূল্যবান জিনিস, সিন্দুকের ভগ্নাবশেষ ভেসে আসছে। তাই এই ছুটির বাকি কটা দিন না হয় কাটিয়ে দিন ময়মনসিংহ মুক্তাগাছা রাজবাড়ি দর্শনে।