দুর্গাপূজা ও তার ইতিহাস
দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব দেবী দুর্গার আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হওয়া বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। শাস্ত্রীয় বিধানে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে এবং চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে দুর্গোৎসব পালন করা যায়। চৈত্র অর্থাৎ বসন্তকালের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা ও আশ্বিন অর্থাৎ শরৎকালের দুর্গাপূজা শারদীয়া দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। বাংলায় শারদীয়া দুর্গাপূজা অধিক জনপ্রিয়।
লুসাই পাহাড়ের বুক চিরে প্রবাহিত কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত প্রাচ্যের রানি চট্টগ্রাম শহরতলির ঐতিহ্যবাহী বোয়ালখালী। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী মেধস মুনির আশ্রম, চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার পূর্বে কড়লডেগা পাহাড় চূড়া মেধস আশ্রম। পৌরাণিক গ্রন্থে আছে সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য- দুজনেরই মন খারাপ। বহু যুগ আগে মেধস মুনি ঋষির কাছে তাঁদের দুঃখের কথা জানালেন এবং এ দুঃখ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী তা জানতে চাইলেন। মেধস মুনি বললেন দেবী মহামায়ার কথা। ত্রিগুণময়ী দৈবীর মায়ার প্রভাবেই জীব দুঃখ পায়। কে এই মহামায়া, তাঁর উৎপত্তি কোথায়- সুরথ রাজা জিজ্ঞেস করলেন। মুনি বললেন, এ মহামায়ার উৎপত্তি নেই, তিনি নিত্যা।
তাঁরই প্রভাবে পেঁচক দিনে চোখে দেখে না, মানুষ দেখে। মা পাখি নিজের পেটে ক্ষুধা থাকলেও ঠোঁটে করে খাবার নিয়ে আসে সন্তানের জন্য। মানুষ মোহগ্রস্ত হয় এ মহামায়ার প্রভাবে। সংসারে মানুষ আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক দুঃখে জর্জরিত হয়। তিনি আবার প্রসন্না হলে সাংসারিক সুখ ও পারলৌকিক সুখ বিধান করেন। মুক্তিকামী সাধককে তিনি মুক্তিও দিয়ে থাকনে। জীবনের দুর্গতি নাশ করেন বলে তিনি দুর্গা নামে পরিচিত। তিনিই আবার শস্যরূপে বিরাজ করে ক্ষুধারূপ অসুর নিধন করেন। এ জন্য দুর্গাপূজায় শস্য দিয়ে তৈরি নবপত্রিকায়ও দেবী দুর্গার আরাধনা হয়। শ্রীশ্রী চণ্ডী গ্রন্থে মেধা ঋষি এ দেবীর স্বরূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন : ‘এবং ভগবতী দেবী সা নিত্যাপি পুনঃ পুনঃ। সম্ভূয় কুরুতে ভূপ জগতঃ পরিপালনম॥ তয়ৈতন্মোহ্যতে বিশ্বং সৈব বিশ্বং প্রসূয়তে। সা’যাচিতা চ বিজ্ঞানং তুষ্টা ঋদ্ধিং প্রযচ্ছতিঋ॥’ (১২/৩৬, ৩৭, ‘সেই ভগবতীর জন্ম-মৃত্যু নেই, তিনি নিত্যা। তাহলেও পুনঃ পুনঃ আবির্ভূতা হয়ে জগৎকে পালন করেন। এই দেবীই বিশ্ব সৃষ্টি করেন এবং তাঁর দ্বারাই জগতের সবাই মায়া-মুগ্ধ হয়। তাঁকে নিষ্কামভাবে আরাধনা করলে তিনি তত্ত্বজ্ঞান দিয়ে সাধককে সব দুঃখের পারে নিয়ে যান। কামনা সহকারে তার আরাধনা করলে ভক্তকে তিনি ঐশ্বর্য দান করেন। প্রলয়কালে সেই দেবী মহাকালী মহামারীরূপে সমগ্র বিশ্ব পরিব্যাপ্ত করেন। সেই জন্মরহিতা সনাতনী দেবীই সৃষ্টিকালে সৃষ্টিশক্তিরূপে (ব্রহ্মারূপে) প্রকাশিতা হন, তিনিই স্থিতি সময়ে স্থিতি শক্তিরূপে (বিষ্ণুরূপে) পালন করেন এবং তিনিই প্রলয়কালে সংহাররূপ (শিবরূপ) ধারণ করেন (চণ্ডী ১২/৩৮-৩৯)।’ তিনিই সুসময়ে পুণ্যবানের ঘরে লক্ষ্মীরূপে সুখ-সমৃদ্ধি দান করেন এবং তিনিই আবার দুঃসময়ে পাপীর ঘরে বিনাশের জন্য অলক্ষ্মীরূপে দুঃখ দারিদ্র্যাদি দান করেন। গন্ধ-পুষ্প-ধূপ-দীপাদি উপচারে দেবীর পূজা ও স্তব করলে সন্তুষ্টা হয়ে দেবী ধনপুত্রাদি, ধর্মে মতি ও শুভ গতি প্রদান করেন (চণ্ডী-১২/৪০-৪১)।
মেধা ঋষি আরো বললেন, স্বর্গের দেবতারা যখন অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে স্বর্গরাজ্য হারিয়ে ফেলেন, তখন এই দেবী অসুরদের পরাজিত করে দেবতাদের আবার স্বর্গরাজ্যের অধিকার ফিরিয়ে দেন। মহিষাসুরও দেবতাদের যুদ্ধে পরাজিত করে দেবতাদের অধিকার নিয়ে নিল। দেবতারা মহামায়ার স্তব-স্তুতি করে মহামায়াকে সন্তুষ্ট করলেন। মহামায়া দুর্গা মহিষাসুরকে সংহার করে দেবতাদের অধিকার-স্বর্গরাজ্য ফিরিয়ে দিলেন। সৃষ্টির এক কল্পের প্রারম্ভেও মধু-কৈটভ নামক দানবদের ধ্বংস করে এই দেবী সৃষ্টি রক্ষা করেন। শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করেও মহামায়া দুর্গা ধর্ম ও সৃষ্টি রক্ষা করেন। রাবনবধের সময়ও রামচন্দ্র শ্রীশ্রী দুর্গার আরাধনা করেন। মেধা ঋষির পরামর্শে সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য মাটির প্রতিমায় দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার আরাধনা করে তাদের কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করেন। রাজা সুরথ রাজ্য ফিরে পান এবং মৃত্যুর পর সাবর্ণি মনু হয়ে অতিদীর্ঘকাল পৃথিবীতে রাজত্ব করেন। আর সমাধি বৈশ্য মহামায়ার আশীর্বাদে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে।
জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখময় এ সংসার থেকে মুক্ত হয়ে পরমানন্দ লাভ করেন। এ ঐতিহ্য স্মরণ করে এখনো দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয়। তাই জগতে প্রথম দুর্গাপূজা বলে বিশ্বাস করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে।
দুর্গাপূজা বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্গত একাধিক রাষ্ট্রে পালিত হয়ে থাকলেও, এটি বিশেষ করে বাঙালিদের উৎসব হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় এই উৎসবের জাঁকজমক সর্বাধিক। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ও বিশেষ উৎসাহে এই উৎসব পালন করে থাকেন। এমনকি আসাম ও উড়িশ্যাতেও দুর্গাপূজা মহাসমারোহে পালিত হয়ে থাকে। বর্তমানকালে পাশ্চাত্য, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশগুলোতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা কর্মসূত্রে অবস্থান করেন, সেখানেও মহাসমারোহে দুর্গোৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে। এই কারণে সারা বিশ্বের কাছেই বর্তমানে বাংলার অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে দুর্গোৎসব। ২০০৬ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট হলে ভয়েসেস অব বেঙ্গল সিজন নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীর অঙ্গ হিসেবে বিরাট দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন স্থানীয় বাঙালি অভিবাসীরা ও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন; এই দিনটি মহালয়া নামে পরিচিত। সাধারণত আশ্বিন শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে দশম দিন অর্থাৎ দশমী অবধি পাঁচদিন দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। আবার সমগ্র পক্ষটি দেবীপক্ষ নামে আখ্যাত হয়। অন্যদিকে দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিন অর্থাৎ পূর্ণিমায়; এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত ও বার্ষিক লক্ষ্মীপূজার দিন হিসেবে গণ্য হয়। দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি। পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো পরিবারে অবশ্য ১৫ দিনে দুর্গোৎসব পালনের প্রথা আছে। এ ক্ষেত্রে উৎসব মহালয়ার পূর্বপক্ষ অর্থাৎ পিতৃপক্ষের নবম দিন অর্থাৎ কৃষ্ণানবমীতে শুরু হয়ে থাকে। বিষ্ণুপুরের প্রাচীন রাজবাড়ীতে আজও এই প্রথা বিদ্যমান। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় মহাসপ্তমী থেকে বিজয়া দশমী অবধি জাতীয় ছুটি ঘোষিত থাকে; এই ছুটি বাংলাদেশে কেবলমাত্র বিজয়া দশমীর দিনই পাওয়া যায়।
বর্তমানকালে দুর্গাপূজা দুভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে-ব্যক্তিগতভাবে পারিবারিক স্তরে ও সমষ্টিগতভাবে পাড়া-মহল্লায়। ব্যক্তিগত পূজাগুলো নিয়মনিষ্ঠা ও শাস্ত্রীয় বিধান পালনে বেশি আগ্রহী হয়; এগুলোর আয়োজন মূলত বিত্তশালী বাঙালি পরিবারগুলোতেই হয়ে থাকে। অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দারা একত্রিত হয়ে যৌথ উদ্যোগেও দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন। এগুলো সর্বজনীন পূজা নামে পরিচিত। সর্বজনীন পূজার উদ্ভবের ইতিহাসের সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ঐতিহ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আজকাল এই পূজাগুলোতে থিম পূজা অর্থাৎ, থিমভিত্তিক মণ্ডপ ও প্রতিমা নির্মাণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
আজ ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। ২৩ অক্টোবর দেবী দুর্গাকে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে শারদীয় দুর্গোৎসব।