কেন ছুরি দিয়ে হামলা করছে ফিলিস্তিনিরা
দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর নানা নিপীড়ন, অত্যাচার চালিয়ে আসছে। ফিলিস্তিনিরা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করেছে। কিন্তু সম্প্রতি ইহুদিদের ওপর হামলায় রান্নাঘরের ছুরি ব্যবহার করছে তারা। পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরে এ ধরনের হামলায় কয়েকজন ইহুদি নিহত হয়েছে। পরে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে কয়েকজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
ইহুদিদের বিরুদ্ধে যারা এই ছুরি হামলা চালাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই তরুণ। তারা ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রিত পূর্ব জেরুজালেমে বসবাস করে। হিব্রু ও আরবি ভাষায় কথা বলা এসব তরুণ ইসরায়েলি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। তাদের বাবা-মা ইসরায়েলিদের সঙ্গে কাজ করে। প্রথম ইন্তিফাদা তো নয়ই, এমনকি ২০০০ সালের দ্বিতীয় ইন্তিফাদার আঘাতের কথাও তাদের মনে থাকার কথা নয়। কারণ তারা তখন খুবই ছোট ছিল। তবে কেন তারা ইহুদিদের বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছে? তাও আবার সামান্য ছুরি নিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে?
ওয়াশিংটন পোস্টের তথ্যমতে, গত তিন সপ্তাহে ফিলিস্তিনিরা স্ক্রু ডাইভার, বন্দুক, মাংস কাটার ছুরি নিয়ে ইহুদিদের ওপর বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, ব্যক্তিগত সম্ভাব্য এই কারণগুলো হামলাকারীদের হামলা চালাতে উদ্বুদ্ধ করছে। হামলার পেছনে কাজ করছে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব, বসতি সম্প্রসারণ, দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনা এবং সম্প্রতি তাদের গর্ব আল আকসা মসজিদে হামলা ও দখলদারিত্ব কায়েম করা নিয়ে ক্ষোভ।
দেখা গেছে, যে তরুণরা হামলা চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই, পুলিশের খাতায় কোনো অভিযোগ নেই। জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। অনেকটা হঠাৎ করেই, যেন ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরের ছুরি নিয়ে তারা নেমে পড়ছে ইহুদিদের বিরুদ্ধে অভিযানে!
তাদের কাছে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নেই। হাতে কাছে যা পাচ্ছে, তা-ই নিয়ে হামলা চালাচ্ছে। প্রধান অস্ত্র হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে ছুরি, চাপাতি, স্ক্রু ডাইভার, গাড়ি ইত্যাদি।
কয়েক দিন আগে মধ্যবয়সী এক ফিলিস্তিনি কারিগর গাড়ি চাপা দেন এক বৃদ্ধ ইহুদিকে। ১৩ বছর বয়সী এক ফিলিস্তিনি বালক ইসরায়েলি এক শিশুকে ছুরিকাঘাত করে। এ সময় তার সঙ্গে তার এক ভাই ছিল। তার বাবা জানিয়েছেন, তাঁর ছেলে ছুরি নিয়ে বের হয়েছে। এটি তিনি জানতেন না।
অন্য এক হামলাকারীর আত্মীয় বলেন, ক্রোধের মূল কারণ হচ্ছে ‘অধিগ্রহণের অবমাননা’।
সম্প্রতি জেরুজালেমের ওল্ড সিটিতে অতি কট্টর এক ইহুদির ওপর হামলা চালায় এক কিশোর। তার বাবা বলেন, ফিলিস্তিনের হেবরন নগরীর এক তল্লাশি চৌকিতে এক মেয়েকে ইসরায়েলি সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করে। তার লাশ রাস্তায় ফেলে রাখার ভিডিও দেখে তাঁর ছেলে খুবই বিচলিত হয়ে পড়ে। এটিও হয়তো তাকে হামলায় উদ্বুদ্ধ করেছে।
আরেক ফিলিস্তিনি হামলাকারীর আত্মীয় জানান, জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদে দখলদারিত্বের কারণে ইসরায়েলিদের ওপর তার ভাই হামলা করেছে। তিনি বলেন, এই মসজিদ ফিলিস্তিনিদের গর্ব।
ইসরায়েলি মন্ত্রী ও সংসদের ডানপন্থী সদস্যরা আল আকসা মসজিদ পরিদর্শনের পর ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এই নেতারা বলেছেন, প্রার্থনা করতে ইচ্ছুক ইহুদিদের এই মসজিদ ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত।
১৯ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি আইনের ছাত্র মুহান্নাদ হালাবি এক ইহুদি সৈন্যকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে। মুহান্নাদের বাবা শাফেক হালাবি বলেন, ‘সে এই নতুন প্রজন্মের একটি অংশ। সে দেখছে, এখানে কোনো রাজনৈতিক সমাধান নেই এবং সকল আলোচনা এখানে নিরর্থক।’
মুহান্নাদ ফেসবুকে তাঁর পেজে লিখেছেন, ‘ফিলিস্তিন হচ্ছে একটি অনাথ বালিকার মতো, যাকে শয়তান ইসরায়েল পালক নিয়েছে। এখানে ফিলিস্তিনিরা বিশেষ করে নারীরা অবমাননা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘ক্রোধ, ক্রোধ, ক্রোধ, দীর্ঘ ঘুম থেকে জেগে ওঠো, বিপ্লবের আগুন জ্বালাও।’
কয়েকজন ফিলিস্তিনি মা-বাবা তাঁদের ছেলেরা কোনো ধরনের ভুল কাজ করছে তা মানতে নারাজ। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের সন্তানদের ইসরায়েলি পুলিশ অথবা অস্ত্রধারী ইহুদিরা গুলি করে হত্যা করেছে। এসব অস্ত্রধারীরা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বসতি স্থাপনকারী।
ফিলিস্তিনি নেতাদের অভিযোগ, ইসরায়েলি সৈন্যরা গুলি করার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে ছুরিকাঘাতের ঘটনা সাজিয়েছে।
তবে এর মধ্যে কিছু হামলার ঘটনা নিশ্চয়ই সত্য। ছুরিকাঘাতে ইসরায়েলি নাগরিক আহত ও নিহত হওয়াই তার প্রমাণ। এ ব্যাপারে ফিলিস্তিনি হামলাকারীদের আত্মীয়-স্বজন, ইসরায়েলি পুলিশ ও সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা, ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি রাজনীতিবিদ এবং বিশ্লেষকদের বক্তব্যও রয়েছে।
ইসরায়েলের একটি সীমান্তে ১৮ বছর বয়সী সাঈদ আলী এক ইসরায়েলি সৈন্যকে ছুরিকাঘাত করে। পরে সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। তারা চাচা আসাদ আলী বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম অবমাননা সহ্য করতে পারে না।’
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সহিংসতায় উসকানি দেওয়ায় হামাস জঙ্গিদের এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে দায়ী করছেন। কিন্তু নেতানিয়াহু পশ্চিম তীরে ৪৮ বছরের দখলদারিত্ব ও ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের কথা কখনো উল্লেখ করেননি। এটিই হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের হতাশার মূল কারণ।
ইরসায়েলি নেতৃত্বের অভিযোগ, আব্বাস বক্তব্যের মাধ্যমে উসকানি দিয়েছেন।
কিন্তু ইসরায়েলি সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত তরুণ ফিলিস্তিনিরা কেউ আব্বাসের কথা বলছেন না। এ ব্যাপারে তাদের প্রশ্ন করা হলে তারা বলেছে, এটি অপ্রাসঙ্গিক।
অনেক ফিলিস্তিনিই এই ছুরি হামলাকে ‘অভিযান’ বলে উল্লেখ করেছে। ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলিতে নিহতদের শহীদ বলে আখ্যা দিয়ে তাদের জানাজা, দাফনে অংশ নিচ্ছে।