লাখপতির গল্প
স্বামীর অনুপ্রেরণায় পথচলা নেহার, এখন লাখপতি
সবাই সফল হতে চান। কিছু করতে চাওয়ার বাসনা মনের গভীরে অনেকে লালন করেন। কিন্তু এই মানুষই আবার ‘টাকা নেই, আমার দ্বারা ব্যবসা হবে না, বিশ্বস্ত মানুষ কোথায় পাব, পরিবারে ব্যবসা করেনি কেউ, আমি পারব? আমার জিনিস কিনবে কে?’—এসব সাতপাঁচ ভেবে এক ধাপ এগিয়ে তিন ধাপ পিছিয়ে যান। কিন্তু সালমা নেহা পিছপা হননি। নিজ জেলার ঐতিহ্যবাহী খাবার নিয়ে ফেসবুকে পেজ খুলে বিক্রি শুরু করেছেন। ব্যস, এখন লাখপতি তিনি!
সালমা নেহা চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় আঞ্চলিক খাবার, মৌসুমি ফল হিসেবে আম, লিচু ইত্যাদি বিক্রি করেন। সাথে কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রামের পনিরও আছে। নেহার প্রতিষ্ঠানের নাম ‘টেস্টবিডি’। নিজের উদ্যোক্তা-জীবনের সাফল্যগাথা এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে শেয়ার করেছেন নেহা।
এনটিভি অনলাইন : কেমন আছেন? আপনার টেস্টবিডি সম্পর্কে যদি জানাতেন।
সালমা নেহা : আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আমার আড়াই বছরের সন্তান আর টেস্টবিডি নিয়েই মূলত আমার ব্যস্ততা। তবে মাতৃত্ব এবং উদ্যোক্তা-জীবনের ব্যস্ততা উভয়ই দারুণভাবে উপভোগ করছি। আমার উদ্যোগের নাম টেস্টবিডি। এখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় আঞ্চলিক খাবার, সিজনাল ফল হিসেবে আম-লিচু পাওয়া যায়। সাথে কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রামের পনিরও আছে। টেস্টবিডিতে মূলত এই জেলার খাবারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
এনটিভি অনলাইন : কত দিন ধরে কাজ করছেন? কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
সালমা নেহা : টেস্টবিডি থেকে আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো সাড়া পেয়েছি এবং এখনো পাচ্ছি। ২০২০ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে উদ্যোগের প্ল্যানিং শুরু করে আল্টিমেটলি ফেব্রুয়ারিতে বিজনেস পুরোদমে শুরু। লকডাউনের আগ পর্যন্ত আমার সেল হয়েছে দুই লাখ ৭৮ হাজার টাকা শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের মিষ্টি বেচে। আমার সিগনেচার পণ্য আদি চমচম, যেটা মোস্ট সেলিং প্রোডাক্ট ছিল তখন। লকডাউনে ফুড ডেলিভারি নিয়ে নির্দেশনা আসার পর আমাদের লিচু আর আম যুক্ত হয়। প্রায় এক লাখ ২১ হাজার টাকার লিচু বিক্রি করেছি এবং আমের সেল সাড়ে ১০ লাখ টাকার বেশি।
এনটিভি অনলাইন : নারী উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফর্ম উই কেমন প্রভাব ফেলেছে?
সালমা নেহা : দেশীয় পণ্যের একমাত্র ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম উই-এর হাত ধরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেশি পণ্য উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে হাজারও নারী উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। উই-এর প্রধান উপদেষ্টা শ্রদ্ধেয় রাজিব আহমেদ স্যারের দিকনির্দেশনায় আমার ফুড নিয়ে উদ্যোক্তা-জীবন শুরু। উই গ্রুপ দেশি পণ্যের ক্রেতা থেকে বিক্রেতা ও উৎপাদনকারী সবার জন্য আশীর্বাদ। এমন অনেক বিলুপ্তপ্রায় দেশি পণ্য উঠে এসেছে এবং তার জন্য বাজার তৈরি হচ্ছে, চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য উই-এর প্রতিষ্ঠাতা নাসিমা আক্তার নিশা আপু এবং রাজিব স্যারের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।
এনটিভি অনলাইন : উদ্যোক্তা হয়ে কেমন লাগছে? অনুপ্রেরণা কারা ছিলেন?
সালমা নেহা : উদ্যোক্তা হওয়ার জার্নি এবং বর্তমান সময়; সবকিছু মিলে মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি অসংখ্যবার। আমার এখন গর্ব হয় বলতে যে আমি একজন দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তা। আমার উদ্যোক্তা হওয়ার পথে প্রথমে স্বামীর অনুপ্রেরণা নিয়ে পথচলা শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে ক্লথিং আইটেম নিয়ে। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি এসে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয় নানাবিধ কারণে। ২০২০ সালের শুরুতে আবার সেই ইতি টানা উদ্যোক্তা-জীবনের মোড় পরিবর্তন করে শুরু করি রাজিব আহমেদ স্যার ও স্বামীর সহযোগিতায়।
এনটিভি অনলাইন : পরিবার থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
সালমা নেহা : পারিবারিকভাবে সবাই চাকরিকে প্রাধান্য দিত। ব্যাংক বা সরকারি চাকরির স্বপ্ন যেমনটা বাংলার সব ঘরে ঘরে, ঠিক আমার বেলায়ও তাই। সে জন্য শুরুতে কেউ সেভাবে এগিয়ে আসেনি বা সাপোর্ট করেনি। তবে এখন সবাই বুঝতে পেরেছে, আলহামদুলিল্লাহ, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে সবাই।
এনটিভি অনলাইন : ঐতিহ্যবাহী খাদ্যসামগ্রী নিয়ে কাজ করছেন। আর কী কী পণ্য নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে?
সালমা নেহা : আপাতত কিশোরগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের খাবার নিয়ে কাজ করছি। ভবিষ্যতে এই দুই এলাকার অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী পণ্যসামগ্রী নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে। তবে পণ্য নিয়ে ভালোভাবে স্টাডি করতে হচ্ছে, তাই সময় নিচ্ছি।
এনটিভি অনলাইন : কী পরিমাণ বিক্রি করেছেন এ পর্যন্ত?
সালমা নেহা : এ পর্যন্ত আমার সেল ১৫ লাখ টাকার বেশি, আলহামদুলিল্লাহ। এবং এর পুরোটাই উই গ্রুপের মাধ্যমে।
এনটিভি অনলাইন : খাবারের মান কীভাবে রক্ষা করেন?
সালমা নেহা : খাবার তৈরি থেকে শুরু করে প্যাকেজিং এবং ডেলিভারি পর্যন্ত খাবারের মান ধরে রাখার চেষ্টা করি। নিজস্ব লোকের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে পণ্য তৈরি এবং প্যাকেজিং করি। কোভিড সিচুয়েশনে বাড়তি সেফটি মেইনটেইনে মিষ্টির কাগজের বাক্সের বিপরীতে ফুড গ্রেডেড প্লাস্টিক বক্স করে মিষ্টি ডেলিভারি করছি।
এনটিভি অনলাইন : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সালমা নেহা : ভবিষ্যৎ প্ল্যানিং হলো আমার দুই জেলার পণ্যকে দেশের সব জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া। আদি চমচম ও পনির, এ দুটি পণ্য দুই জেলার ঐতিহ্য বহনকারী পণ্য। কিন্তু সঠিক প্রচারণার অভাবে কারিগরেরা কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিয়েছে। ই-কমার্সের মাধ্যমে সেসব প্রান্তিক কারিগরদের অন্তত ১০ জনের সুদিন ফিরিয়ে আনতে পারলেও আমার অনেক বড় অর্জন হবে বলে মনে করি।
এনটিভি অনলাইন : উদ্যোক্তা হওয়ার পর কোনো মধুর স্মৃতি এবং সফল হতে কাদের বেশি ভূমিকা ছিল?
সালমা নেহা : নারায়ণগঞ্জে আমার একজন ক্রেতা আম অর্ডার করেন ৩০ কেজি। আমি এন্ট্রি করে রাখি। কিন্তু পরের দিন বলেন ৪০ কেজি। যদিও এর আগে বেশ কয়েক বারের রিপিট ক্রেতা আমার ব্যবসায়ের। তখন আমার স্বামীকে আপডেট করতে দেওয়ায় তিনি আবার নতুন করে ৪০ কেজি লিখেছিলেন। কুরিয়ার থেকে যথারীতি আগের দিন ৩০ কেজি আম পাঠানো হলো এবং পরের দিন আবার ৪০ কেজি। আমের কোয়ালিটি আর স্বাদ ভালো হওয়ায় বিন্দু পরিমাণ রাগ তো করেননি, বরং ছবি তুলে পাঠিয়েছেন খুশি হয়ে। ক্রেতার বাবা নাকি একাই একদিনে ১০ কেজি আম খেয়ে ফেলেছেন। এটা আমার কাছে আজীবন মধুর স্মৃতি হয়ে থাকবে। এমন অনেক মধুর স্মৃতি জমা হয়েছে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে।
সবচেয়ে বড় সাপোর্টার আমার স্বামী, সে ডেলিভারি থেকে পণ্য কালেকশন; সব কাজে সহায়তা করে। পাশাপাশি এখন পরিবারের সবাই মোটামুটি সাহায্য করে। আর সফলতার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে উই গ্রুপের মেম্বার, আমার কাস্টমার ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। তাদের সাপোর্ট আর ভালোবাসা না থাকলে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করা খুব কষ্টদায়ক হতো।
এনটিভি অনলাইন : একজন ক্রেতা কেন আপনার পণ্য কিনবে বলে মনে করেন?
সালমা নেহা : কাস্টমাররা দামের চেয়ে বেশি কোয়ালিটিতে বিশ্বাসী। তাই এই একটা কাজে আমি শক্ত অবস্থান ধরে রাখি। পাশাপাশি ক্রেতার সঙ্গে আন্তরিকতার সম্পর্ক। কাস্টমার সার্ভিস থেকে শুরু করে সবকিছুতে সজাগ থাকি, যাতে করে আমার রিপিট কাস্টমারের সংখ্যা অনেক হয়। এ ছাড়া পণ্য উপস্থাপনে এর সঠিক ইতিহাস, উৎপাদন কার্যক্রম ও পণ্য নিয়ে বিস্তারিত কনটেন্টের মাধ্যমে তুলে ধরায় তারা জানতে আগ্রহ প্রকাশ করে প্রথমে এবং জানার পর সেই পণ্যের ক্রেতা হওয়ার আগ্রহ দেখায়।
এনটিভি অনলাইন : উদ্যোক্তা হতে পেরে আপনার অনুভূতি?
সালমা নেহা : একজন উদ্যোক্তা হতে পেরে আমি আমার উদ্যোগ নিয়ে সর্বদা গর্ববোধ করি। মাঝে কিছুদিন চাকরি করলেও বিজনেসের জন্য সেটা ছেড়ে এখন আমি ফুলটাইম উদ্যোক্তা।
এনটিভি অনলাইন : বেকার সমস্যা নিরসনে আপনার পরামর্শ কী?
সালমা নেহা : সবাইকে সরকারের কথা মাথায় রেখে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। চাকরি করব, না কি চাকরি দেব; এই প্রত্যয় নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে ছাত্রজীবন থেকেই। দেশে কারিগরি শিক্ষা, দেশীয় পণ্য নিয়ে প্রচার-প্রচারণা আর সেগুলো নিয়ে কীভাবে কাজ করবে, সে জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্যাম্পেইন এবং গণমাধ্যমে প্রচারণা বাড়াতে হবে।
এনটিভি অনলাইন : আপনার মতো লাখপতি হতে কী করতে হবে?
সালমা নেহা : বিজনেস ও পণ্য সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে হবে। নিয়মিত পণ্যের সঠিক তথ্য দিয়ে কনটেন্ট আকারে সবার মাঝে তুলে ধরতে হবে। সবচেয়ে বড় যেটা, তা হলো দীর্ঘ সময় ধৈর্য ধরে লেগে থাকার মানসিকতা থাকতে হবে। উই-তে নিয়মিত সক্রিয় থাকতে হবে। কারণ, উই হলো একটা মার্কেটপ্লেসের মতো। আপনি যত বেশি সময় দেবেন, তত বেশি ভালো ফিডব্যাক পাবেন। তা ছাড়া মানুষ আপনাকে আগে জানবে, চিনবে এবং আস্থা অর্জন করবে; তারপর পণ্য কিনবে। উই-এর একটা স্লোগান আছে : আমরা যাকে চিনি, তার কাছ থেকে কিনি।