লাখপতির গল্প
বিদেশে বিছানার চাদর রপ্তানির স্বপ্ন নাজমা সুলতানার
ব্যাংকার বাবার মেয়ে নাজমা সুলতানা। এমবিএ করেছেন। স্বপ্ন ছিল ব্যাংকার হবেন। সব কিছুই ঠিক ছিল, কিন্তু আর ব্যাংকার হয়ে ওঠা হয়নি তাঁর, হয়েছেন উদ্যোক্তা। শুধু উদ্যোগ নিয়ে থেমে থাকেননি। সংসার সামলে হয়েছেন সফল। এখন এ লাখপতির অধীনে কাজ করেন ৬০ থেকে ৭০ জন কর্মচারী।
হ্যাঁ, এই সুশিক্ষিত উদ্যোক্তার নাম নাজমা সুলতানা। সুদূর বগুড়ায় বসে তাঁর জাবিন’স কালেকশন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশে। এনটিভি অনলাইনকে নিজের সাফল্য ও চড়াই-উৎরাইয়ের গল্প বলেছেন নাজমা।
তো, কেমন আছেন নাজমা? উত্তরে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো ব্যস্ত সময় পার করি সব সময়, জাবিন’স কালেকশনের সম্মানিত কাস্টমারের অর্ডারের পণ্যের প্রস্তুতি নিয়ে।’
জাবিন’স কালেকশন মূলত একটি অনলাইন শপ। ২০১২ সালে এর যাত্রা। ২০১২ সালে তিনি অন্তর্জালে একটি পেজ খোলেন। তবে সেভাবে সেখানে সক্রিয় ছিলেন না। তবে অফলাইনে তখন তাঁর কাজ চলত অল্প পরিসরে। ২০১৪ সাল থেকে আবার অনলাইনে কাজ শুরু করেন। এবার একটু ভিন্নভাবে। ছবি আপলোড করেন এবং সেই পণ্যের প্রি-অর্ডার নেওয়া শুরু করেন। এটা সে সময় খুব চ্যালেঞ্জিং একটা ব্যাপার ছিল। তবে নাজমার পণ্যের গুণগত মান ভালো হওয়ায় পেছনে তাকাতে হয়নি।
নাজমা সুলতানা জানান, বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছেন এখন। নিজের কাজ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমার কাজের সময়টা অনেক লম্বা। তবে টানা কাজ করতে পারিনি। বলতে পারেন, থেমে থেমে চলতে হয়েছে আমাকে। কখনো সংসার, কখনো মায়ের দায়িত্ব পালন—তবে থেমে যাইনি। যখনই শুরু করেছি, আল্লাহর রহমতে ভালো সাড়া পেয়েছি।’
নাজমা সুলতানা বলেন, ‘নারী উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন পূরণের প্ল্যাটফর্ম উই (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম—উই)। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এটা আশীর্বাদ। এই প্ল্যাটফর্মে সবচেয়ে যেটা আমার ভালো লাগে, তা হলো নতুন উদ্যোক্তাদের তুলে আনা, গ্রামের উদ্যোক্তাদের সামনে আনা। দেশীয় পণ্য নিয়ে সুন্দর একটা প্ল্যাটফর্ম। সত্যি, এখানকার একজন সদস্য হতে পেরে আমি খুব আনন্দিত।’
তো, নারী উদ্যোক্তা হয়ে কেমন লাগছে? এনটিভি অনলাইনের এমন প্রশ্নে নাজমার উত্তর, ‘প্রথম যখন কাজ করতাম, নতুন নতুন কিছু করতাম, প্রচণ্ড ভালো লাগত। আমি ছোটবেলা থেকে সুই-সুতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটা ছিল ভালোবাসা। কবে উদ্যোক্তা হয়েছি নিজেও জানি না। আর যে কাজটা ভালোবাসা থেকে করছি, সেটা ভালোলাগার জায়গা।’
অনেকে বলেন, সফল হতে হলে অন্য কোনো ব্যক্তির অনুপ্রেরণা জরুরি। প্রেরণা মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। সেটা তো সত্যই। তবে নাজমা সুলতানা বললেন ভিন্ন কথা। তাঁর অনুপ্রেরণা সুই-সুতার প্রতি ভালোবাসা। সেটা ধরলে, তিনি নিজেই নিজের প্রেরণা। তবে হ্যাঁ, নাজমার পরিবার সব সময় তাঁকে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে। তা না হলে এতটা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না এই সফল উদ্যোক্তার।
নারী উদ্যোক্তাদের ফেসবুক গ্রুপ উই-এর প্রভাব নাজমার জীবনে অনেক। করোনাকালে সবাই যখন আতঙ্কিত, সে সময় পাশে থেকেছে উই। আতঙ্ক জয় করে কাজে মনোযোগ দিতে শিখিয়েছে গ্রুপটি। নাজমার ভাষ্যে, ‘যেখানে সারা দেশে কেনাবেচা বন্ধ, আমাদের কেনাবেচা সেখানে সচল। এ সময় লাখপতি হয়েছি। এখনো সেটা আল্লাহর রহমতে ভালো চলছে।’
নাজমা সুলতানা কাজ করছেন কাটওয়াক, অ্যামব্রয়ডারি, সুতার কাজ। তাঁর পণ্যের মধ্যে রয়েছে চাদর, থ্রিপিস, শাড়ি, কুশন কভার, বাচ্চাদের পোশাক, টেবিল ম্যাটসহ অনেক কিছুই। আর আয় কেমন? নাজমা জানান, ২০২০ সালের মার্চ থেকে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা আয় হয় তাঁর। আর মান? নাজমার স্পষ্ট উচ্চারণ, ‘আমি কাপড় নিয়ে যেহেতু কাজ করি, কাপড়ের কোয়ালিটি এবং রঙের কোয়ালিটির দিকে নজর দিই বেশি। সব সময় চেষ্টা করি নিজে যাচাই করে কাপড় কিনতে।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে নাজমা সুলতানা বলেন, ‘আমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করি। তাদের সঙ্গে যেটা নিয়ে বেশি কাজ করি, সেটা হলো আমার কাটওয়াকের চাদর। আমার ইচ্ছে বিদেশে বিছানার চাদর রপ্তানি করা। এ ছাড়া কুরুশ পণ্যের প্রসার ঘটানো।’
নাজমা সুলতানার এক মধুর স্মৃতি, ‘আমার কাজের সঙ্গী প্রায় ৬০-৭০ জন নারী। তাঁদের যখন প্রাপ্যটা বুঝিয়ে দিতে পারি, তখন খুব ভালো লাগে। করোনা-পরিস্থিতিতে যখন আমার এক সহকর্মীকে টাকা দিচ্ছিলাম, সে কেঁদে দিল। এটা ছিল একটা সত্যিকারের সুখের স্মৃতি।’
মা-বাবা, স্বামী, স্বামীর পরিবার, স্বজন সবাই নাজমার পাশে ছিলেন। বিশেষ করে সহকর্মীরা নিরন্তর সহযোগিতা করেছেন নাজমাকে। তবে মজার ব্যাপার হলো, নাজমা কখনোই ভাবতে পারেননি উদ্যোক্তা হবেন। বাবা ব্যাংকার ছিলেন। এমবিএ করেছিলেন ব্যাংকার হওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ওই যে জীবন যেখানে টেনে নিয়ে যায়, তা কি আর যায় থামানো? নাজমার দুচোখভরা শুধু সামনে এগোনোর পথ। থামা নেই।