লাখপতির গল্প
সততা থাকলে সাফল্য আসবেই : ফারহানা
পরিবারের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেই নিজের উদ্যোগ সামলাচ্ছেন ফারহানা ফেরদৌস। তাঁর রোদোসী’স ক্রিয়েশন ও টুপি গ্যালারি নামে দুটি অনলাইন পেজ আছে। এ উদ্যোগকে কীভাবে আরও এগিয়ে নেওয়া যায়, সেই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে তাঁর দিন কাটছে। ব্যস্ততা ভালো লাগে তাঁর।
অনলাইনে ফারহানা মূলত কুশির পণ্য নিয়ে কাজ করেন। এসবের মধ্যে রয়েছে বাচ্চাদের জামা, টুপি, কুশন কভার, বেডশিট, প্লেসমেন্ট অর্থাৎ যাবতীয় কুশির পণ্য। তা ছাড়া হ্যান্ড এমব্রয়ডারি ও ব্লকের থ্রি-পিস, শাড়ি, পাঞ্জাবি নিয়েও কাজ করেন তিনি। সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় এ উদ্যোক্তার। ফারহানা জানান, তাঁর সাম্প্রতিক ব্যস্ততাসহ উদ্যোক্তা-জীবনের আদ্যোপান্ত।
তো কত দিন ধরে কাজ করছেন ফারহানা? এ উদ্যোক্তার উত্তর, ‘২০১৮ সাল থেকে অনলাইন ও অফলাইনে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছি। ঢাকা থেকে উদ্যোগ পরিচালনা করলেও আমি মূলত কিশোরগঞ্জের উদ্যোক্তা। কুশির বিভিন্ন ধরনের পণ্য, ব্লক ও হ্যান্ড এমব্রয়ডারি পণ্য নিয়ে কাজ করছি সেই ২০১৮ সাল থেকে। আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি। বেশির ভাগ ক্রেতাই রিপিট কাস্টমার। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, অনলাইনে ক্রেতারা পণ্যের ছবি দেখে অর্ডার করেন। যাঁরাই পণ্য নিয়েছেন, বলেছেন—ছবির চেয়েও আপনার পণ্যের মান অনেক ভালো।’
উদ্যোক্তা হয়ে কেমন লাগছে? উত্তরে ফারহানা বলেন, ‘কখনও উদ্যোক্তা হব, এমন পরিকল্পনা ছিল না। পড়াশোনার প্রতি বেশ মনোযোগী ছিলাম এবং সেভাবেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলাম, বিসিএসের প্রিপারেশন ছিল খুব ভালো। পরে লেকচারার (প্রভাষক) হিসেবে চাকরি হলো একটি কলেজে। পোস্টিং হলো ঢাকার বাইরে। কিন্তু একটা সময় এলো, যখন সিদ্ধান্ত নিতে হলো, হয় চাকরি না হয় নিজের সুস্থতার জন্য ট্রিটমেন্ট। রিজাইন দিলাম চাকরি থেকে। শুরু হলো আমার অখণ্ড অবসর! যেটা আমি কখনওই পছন্দ করতাম না, সব সময় ব্যস্ত থাকতে ভালো লাগত। তাই সঙ্গী হলো মোবাইল ফোন। ইউটিউবে বিভিন্ন ক্রাফটের ভিডিও দেখতাম আর ঘরে বসে সেগুলোই চেষ্টা করতাম। আমার ইচ্ছা আর আগ্রহ দেখে আমার স্বামী একদিন বললেন—তুমি তো ঘরে বসেই কিছু করতে পারো। যা যা দরকার হয়, সেগুলো না হয় আমিই কালেক্ট করে দেব। সেই থেকেই আমার উদ্যোক্তা-জীবনের পথচলা, খুব এনজয় করছি। ক্রেতাদের সুন্দর সুন্দর ফিডব্যাক যখন আসে, খুব ভালো লাগে; এভাবেই এগিয়ে যেতে চাই।’
পরিবার থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন? ফারহানা ফেরদৌসের ভাষ্য, ‘আলহামদুলিল্লাহ, পরিবার সব সময়ই আমার যেকোনো বিষয়ে সাপোর্টিভ ছিল, যদিও আমার মা-বাবা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যরা চাইতেন আমি চাকরি করি। তাঁদের চাওয়াটা কোনো ভুল ছিল না। কারণ, আমি সেভাবেই প্রিপারেশন নিয়েছিলাম এবং এক সময় এটাই স্বপ্ন ছিল। কিন্তু যখন চাকরি ছেড়ে দিতে হলো, তখন সবাই একটু আপসেটই হয়েছিলেন। তারপর যখন আমার স্বামীর উৎসাহে আবার নতুন করে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করলাম, তখন সবাই এটাই বুঝেছিলেন যে আমি থেমে থাকার মেয়ে নই। যেখানে যখন সময় দিয়েছি, সেখানে ভালোটাই করেছি। আস্তে আস্তে পরিবারের সবাই উৎসাহ দেওয়া শুরু করল। আর আমি মনে করি, আমি খুবই ভাগ্যবান। যখন যেটা করেছি, পরিবার থেকে সাপোর্ট পেয়েছি। তাঁরা আমাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। আমার মা-বাবা কিংবা ভাইবোনেরা এবং আমার শ্বশুরবাড়ির সবার সহযোগিতা সব সময়ই ছিল। বিশেষ করে আমার স্বামীর সহযোগিতা আমাকে উদ্যোক্তা হতে অনেক বেশি কাজে দিয়েছে। ছুটির দিনগুলোতে তিনি বিশ্রাম না নিয়ে আমার সঙ্গে পণ্যের সোর্সিং থেকে শুরু করে ডেলিভারি, এমনকি অন্যান্য সব কাজেই পাশে থেকেছেন, যাতে আমি কখনওই একাকিত্ব বোধ না করি। সত্যিই এ ক্ষেত্রে আমি অনেক বেশি ভাগ্যবান।’
সামনে দুই বড় উৎসব—পহেলা বৈশাখ ও পবিত্র ঈদুল ফিতর। কেমন প্রস্তুতি? ফারহানা বলেন, ‘যেহেতু পহেলা বৈশাখ এবং ঈদ প্রায় পাশাপাশি উদযাপিত হবে, তাই ঈদকে ঘিরেই আমার প্রস্তুতি। কারণ, ঈদের প্রস্তুতি ভালোভাবে নিতে পারলে পহেলা বৈশাখ এমনিতেই কভার করা যাবে। সেজন্য এখন থেকেই আমার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। যেহেতু ঈদের প্রায় আড়াই মাস সময় আছে, তাই কী ধরনের পণ্য প্রস্তুত করব, সেগুলো তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছি। ইনশাআল্লাহ, আশা করি ঈদকে ঘিরে আমার উদ্যোগ বেশ সাড়া ফেলবে।’
ফারহানা আরও বলেন, ‘ঈদকে ঘিরে আমার টার্গেট অন্য রকমের। গত তিন বছরে আমার উদ্যোগের পরিধি যতটা বৃদ্ধি পেয়েছে, আমি আশা করছি আসছে ঈদকে ঘিরে তা আরও বৃদ্ধি পাবে। আলহামদুলিল্লাহ, আমার উদ্যোগের প্রতি গ্রাহকদের অভূতপূর্ব সাড়া দেখে আমি আশা করতেই পারি এই ঈদে আমার সেই টার্গেট পূর্ণ হবে।’
ফারহানা প্রাণিবিদ্যায় স্নাতক এবং মৎস্যবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। যেহেতু তিনি অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনা করছেন, তাই আইটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য নিয়মিত পড়াশোনা করেন। নিজেকে দক্ষ সংগঠক হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁর উদ্যোক্তা-জীবন প্রায় তিন বছর। উদ্যোক্তা-জীবনে প্রাপ্ত আয়ের গ্রাফ প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। বর্তমানে চার জন কর্মী আছে তাঁর। তা ছাড়া যখন অর্ডার বেড়ে যায়, তখন কয়েকজন খণ্ডকালীন কর্মী কাজ করেন।
এরই মধ্যে লাখপতি বনে গেছেন ফারহানা ফেরদৌস। তিনি বলেন, ‘কখনও হতাশ হওয়া যাবে না। পরিশ্রম আর সততার সাথে কাজ করলে সাফল্য আসবেই।’
ফারহানা ফেরদৌসের জন্মস্থান কিশোরগঞ্জ। তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, ‘আমার এলাকার অধিকাংশ মানুষই প্রবাসী, তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সেখানকার অধিকাংশ নারীই স্বামীর উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। আসলে নিজেরা কীভাবে স্বাবলম্বী হবে, সংসারে আয়ের অবদান থাকবে, এ বিষয়ে তাদের কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই। তাই আমার ইচ্ছা আছে, সেখানে একটা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার, তারা যাতে স্বাবলম্বী হতে পারে। তা ছাড়া আমি যেহেতু কুশির পণ্য নিয়ে কাজ করি, তাই আমাদের স্থানীয় ক্রেতার পাশাপাশি দেশের বাইরের ক্রেতাদের আমি টার্গেট কাস্টমার হিসেবে নিতে চাই। কারণ, বিদেশে কুশির পণ্যের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তা ছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশি যাঁরা আছেন, তাঁদের মাধ্যমে আমি বহির্বিশ্বে আমাদের দেশীয় পণ্যকে ছড়িয়ে দিতে চাই।’
ফারহানার মতে, কাজের প্রতি প্রবল ইচ্ছাশক্তি, উপস্থিত বুদ্ধি, ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করা, সবকিছু সমন্বয় করার ক্ষমতা থাকা একজন উদ্যোক্তার বিশেষ গুণ। সেই গুণগুলো এ উদ্যোক্তার আছে। ফারহানার মতো আরও নারী উদ্যোক্তা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ুন, এ প্রত্যাশা সবার।