সাগরে ডাকাতির প্রতিবাদে রাস্তায় জেলেরা
সাগরে জলদস্যুদের অব্যাহত ডাকাতি, অপহরণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্যের প্রতিকার চেয়ে বরগুনা শহরে আজ মঙ্গলবার বিক্ষোভ করেছেন সহস্রাধিক জেলে। তাঁরা সড়কে মানববন্ধন করেছেন। পরে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সাগরে ডাকাতি, অপহরণ বন্ধ না হলে তাঁরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গিয়ে অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
আজ সকাল থেকেই জেলার বিভিন্ন উপজেলার শত শত জেলে নৌপথে ট্রলারে করে বরগুনা শহরের নৌবন্দরে এসে উপস্থিত হতে থাকেন। এ সময় তাঁরা জলদস্যুদের হাতে নিহত, আহত, নিখোঁজ ও অপহৃত জেলেদের পরিবারের পুনর্বাসন এবং যথাযথ ক্ষতিপূরণ চেয়ে স্লোগান দেন। বেলা ১১টার দিকে প্রেসক্লাব চত্বরে শুরু হয় মানববন্ধন। এ সময় এক সমাবেশে বক্তব্য দেন জেলার ট্রলার মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা।
জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল মান্নান মাঝি বলেন, ‘বহুবার আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের শরণাপন্নও হয়েছি শতবার। তারপরও আশানুরূপ কোনো ফল পাইনি। বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের হত্যা, লুণ্ঠন আর অপহরণ বাণিজ্যসহ নিষ্ঠুর তাণ্ডব যেন বেড়েই চলেছে। এখনো প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৫০টি ট্রলার ডাকাতির শিকার হচ্ছে। এবারের এ আন্দোলনেও যদি কোনো কাজ না হয় তবে আগামী ১৫ ডিসেম্বরের পরে উপকূলের হাজার হাজার জেলে ও তাদের পরিবারবর্গ নিয়ে আমরা রাজধানী ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেব।’
সমাবেশে জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জানান, গত ১০ বছরে গভীর সমুদ্রে জলদস্যুদের হাতে এ পর্যন্ত শতাধিক জেলে নিহত হয়েছেন। ডাকাতির শিকার হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ট্রলার। অপহৃত হয়েছেন পাঁচ হাজারেরও বেশি জেলে। ডাকাতি করে মাছ-ট্রলার-জাল এবং খুচরা যন্ত্রাংশ লুণ্ঠনসহ মুক্তিপণ হিসেবে দরিদ্র জেলেদের কাছ থেকে জলদস্যুরা হাতিয়ে নিয়েছে হাজার কোটিরও বেশি টাকা।
গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জানান, পাথরঘাটায় কোস্টগার্ডের স্থায়ী ঘাঁটি থাকা সত্ত্বেও গভীর সমুদ্রে জলদস্যুদের অব্যাহত অত্যাচারে দিশেহারা হয়ে পড়েছে উপকূলের হাজার হাজার জেলে, মৎস্য ব্যবসায়ীসহ তাঁদের পরিবারবর্গ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের হাতে অপহৃত হয়ে এখনো বন্দি রয়েছেন বরগুনা জেলার শতাধিক জেলে। বরগুনাসহ আশপাশের জেলার সব অপহৃত জেলেদের সংখ্যা আরো কয়েকগুণ বেশি হবে বলে জানান গোলাম মোস্তফা।
এদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী সদস্যকে ছাড়িয়ে আনতে জলদস্যুদের বেঁধে দেওয়া শর্ত অনুযায়ী মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে ভুক্তভোগী শত শত জেলে পরিবার।
গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জানান, শর্ত অনুযায়ী মুক্তিপণের টাকা নিয়ে জলদস্যুদের আস্তানায় দেখা করতে না যাওয়ায় অপহৃত জেলেদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে জলদস্যুরা। শুধু তাই নয়, নির্যাতনের সময় অপহৃত জেলেদের চিৎকারের শব্দ মোবাইল ফোনে তাঁর স্ত্রী ও স্বজনদের শোনানো হয় বলেও জানান তিনি। এতে নারী ও শিশুসহ ওই সব অপহৃত জেলে পরিবারের সবাই এখন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন বলেও তিনি জানান।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলে নেতা জানিয়েছেন, জলদস্যু সমস্যা নিরসনে কোস্টগার্ডের যে ভূমিকা তাঁরা প্রত্যাশা করেন তা তারা পান না। বরং সাম্প্রতিক সময়ে র্যাব ৮-এর সদস্যদের সক্রিয় ভূমিকায় তাঁরা অনেকটা আশাবাদী বলে জানান।
জেলে নেতারা বলেন, র্যাব ৮-এর শক্তিশালী অবস্থানের কারণে এরই মধ্যে এ এলাকার জলদস্যুরা বর্তমানে অন্যত্র অবস্থান নিয়েছে। বেশির ভাগ জলদস্যু এখন র্যাব ৬-এর আওতাধীন এলাকায় গা ঢাকা দিয়েছে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে র্যাব ৬ এলাকায় লুকিয়ে থাকা সেসব জলদস্যুদের নির্মূলে আরো সক্রিয় হতে তারা র্যাব ৬-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান।
সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জেলে, ট্রলার মালিক ও শ্রমিক নেতারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল ইসলামের হাতে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে লেখা স্মারকলিপি তুলে দেন।
এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল ইসলাম জানান, বঙ্গোপসাগরে জলদস্যু সমস্যা অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। এ সমস্যা সমাধানে বর্তমান সরকার বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিনি জানান, জেলেদের দেওয়া স্মারকলিপি পেয়েছেন এবং যথাযথ নিয়মেই তা প্রধানমন্ত্রী বরাবরে পাঠিয়ে দেবেন।