ফ্যাশন
লেগারফেল্ড মহাকাব্যের মঞ্চায়ন
সরাসরি দেখার অভিজ্ঞতা নয়। রিপোর্ট পড়া আর ভিডিও দেখা। তাতেই মন্ত্রমুগ্ধতা। কোথা থেকে এ লেখা শুরু করা যাবে তা ভাববারই বিষয়। অবশ্য সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? কারণ এ যে শ্যানেলের বার্ষিক উপস্থাপনা। এ যে কার্ল লেগারফেল্ড নামের অশীতিপর তরুণের ইন্দ্রজাল। এর জন্য গোটা বিশ্ব উন্মুখ থাকে বছর ভর। তাতে অবশ্য হলফ করে বলা যায় বছরের পর বছর ভুবনভরা ফ্যাশন অনুরাগীদের হতাশ হওয়ার কারণ ঘটেনি।
এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি যাঁরা করেন, খোঁজখবর রাখেন তাঁদের স্মরণে থাকার কথা ২০১২ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে অনুষ্ঠিত তাঁর ভারত অনুরাগ কালেকশন ‘প্যারিস-বোম্বে’ বিশ্বকে বিমোহিত করেছিল। পরের বছর তিনি স্কটল্যান্ডকে তুলে আনেন পোশাকে। এডিনবরায়। ২০১৪ সালে তিনি বেছে নেন টেক্সাসকে। সৃজন প্রেরণা হিসেবে। সেবার তাঁর সৃষ্টির উদ্ভাসে উজ্জ্বল ছিল ডালাস।
সেই ধারা যে অব্যাহত থাকবে তা সবারই জানা ছিল। কিন্তু এমন চমক লাগার জন্য পৃথিবী মনে হয় না প্রস্তুত ছিল। এবার শহর রোম। শ্যানেল হাউসের ফ্যাশন মায়েস্ত্রো লেগারফেল্ড ভেল্কিটা দেখালেন সেখানেই- রোমে তুলে আনলেন প্যারিসকে। শ্যানেলের প্যারিস। বৃহদায়তনের মুভিস্টুডিও লেগারফেল্ডের ইশারায় বদলে গেল পারি নগরীতে। তবে মাত্র কয়েকদিন আগের রক্তাক্ত পারি নয়। বরং প্রাণময়, চিরচারিত পারি। অবশ্য ৫০ ও ৬০ দশকের। সেই কফি শপ, রেস্তোরাঁ, প্যাতিসেরি, ফিশমঙ্গার, মেট্রো স্টেশন-সবই অবিকল উঠে এলো লেগারফেল্ডের ছুঁ-মন্ত্রে। অতীত দিনের এই মেট্রো স্টেশনের পাতাল ফুঁড়েই তো উঠে এলেন নতুনদিনের সুন্দরীরা। কোকো শ্যানেলের রক্তাক্ত পারির প্রতি, পারিবাসীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর শ্রেয়তর উপলক্ষ এর চেয়ে আর কী হতে পারে। তিনি বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করলেন সহিংসতার বলি হওয়া নিরীহ, নিরপরাধ মানুষদের। যাদের অধিকার ছিল পৃথিবীর পথে, পারির পথে আরো অনেক বছর হেঁটে বেড়ানোর। লেগারফেল্ড নিজে স্বীকারও করেছেন, এটা ছিল প্যারিসের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর প্রয়াস মাত্র।
স্টুডিওর নাম সিনেসিত্তা। ৯৮০০ স্কয়ারফুট। বানিয়েছিলেন বেনিতো মুসোলিনি। ১৯৩৭ সালে। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ফেলিনির প্রিয় স্টুডিও। তাঁর নির্দেশনায় যেখানে নির্মিত হয়েছে ক্যাসানোভা। এ ছাড়া লা দলচে ভিতা, বেনহুর, হেলেন অব ট্রয়, ক্লিওপেট্রা- বিখ্যাত সব ছায়াছবির সূতিকাগৃহ এই সিনেসিত্তা। এখানেই পারির রোমান্টিক মুডকেই ধরতে চেয়েছিলেন লেগারফেল্ড। কিন্তু সব নস্যাৎ করে দেয় ১৩ নভেম্বরের ঘটনা। ফলে তিনিও মুড বদলে ফেলেন। বর্ণিল নয়, সাদা আর কালোতেই সেজে ওঠে মঞ্চ। ৮০০ দর্শক সানন্দ বিমূঢ়তায় চাক্ষুষ করেন ১১ মিনিটের হোমেজ টু প্যারিস। ক্যাটওয়াক নয়, যেন অনবদ্য নিপুণতায় অভিনীত কোনো ছায়াছবি। তার মাঝে অবশ্যই অনুরণিত হয়েছে বিষাদের করুণ রাগিণী। আর ক্যাটওয়াক দেখতে দেখতে সবাই ফিরে গেছেন পারির পথে। স্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন হয়েছেন। নিজের শহরকে এভাবে ভালোবাসতে পারার লেগারফেল্ডীয় প্রয়াসকে নিশ্চয়ই অশরীরী কোকো শ্যানেল সাধুবাদ জানিয়েছেন।
সেই ১৯৬০ দশকের প্যারিসকে তুলে আনার প্রচেষ্টা ছিল লেগারফেল্ডের। যে সময় প্যারিস থেকে রোমে আসতেন ফরাসি অভিনেত্রীরা। ইতালীয় সিনেমায় অভিনয়ের জন্য। এই সেট আর আলোছায়ার আবহ তৈরি করতে তাঁর টিমের লেগেছে ছয় সপ্তাহ। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় রাতে হাড় হিমকরা শৈত্যপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দর্শকরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করেছেন কার্ল কারিশমা চাক্ষুষ করার জন্য। ৬২ জন মডেল হেঁটেছেন তাঁর নতুনতম সংগ্রহ গায়ে চড়িয়ে। তবে এমনটা, এই একরঙা সিটিস্কেপ না হলে পোশাক হারিয়ে যেত বৈকি মঞ্চের ব্যাকড্রপে। মনে হবে এই মঞ্চ ঠিক যেন পুরোনো দিনের নির্বাক চলচ্চিত্রের সেট। তবে প্যারিসের এই লুক আসলে লেগারফেল্ডিও ফ্যান্টাসি। তাঁর মতে, এটা আদতে রোমান্টিক আইডিয়া, পুরোদস্তুর রোমান্টিসিজম।
এখানেই মেয়েরা হাঁটলেন স্লিপ ড্রেস, গ্লসি লেদার স্কার্ট, ব্যাকলেস স্টিলেট্টো, বক্সি পি কোটস, টুইড ড্রেস, হাইনক রাফলড ব্লাউজ, বিডেড পার্ল পাম্প, টুইড পালাজো পাজামা, ক্রপড অ্যান্ড কেপড জ্যাকেট পরে। সাদা আর কালোর উপস্থিতি দিয়ে সময়কে যেন থামিয়ে রেখেছিলেন এই ফ্যাশনঋষি।
প্রদর্শিত পোশাকে একধারে মূর্ত হয়েছে নস্টালজিক প্যারিস আর আধুনিক ফ্যাশন ক্যাপিটাল প্যারিস। নিটওয়্যারে ধূসর বর্ণক্রম, জটিল ডিজাইনের নিখুঁত উপস্থাপনায় প্রতিটি পোশাক ছিল অনবদ্য।
মডেলদের পোশাক আর সঙ্গতিপূর্ণ মেকআপে কোথাও ছিল না সেই আবেদন যা ফ্যাশন শোতে থেকেই থাকে। বরং বিষণ্ণতার অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা ছিল পুরোটাই। এই হাঁটা সে জন্যই এই হাঁটা নয়। যেন এই হাঁটা লজ্জার- ওয়াক অব শেম।
এখানে একটু উল্লেখ প্রয়োজন। এই ‘ম্যাটি ডিআ’ শোকে বলাই যেতে পারে অমিতব্যয়িতার চূড়ান্ত। আসলেও তাই। কিন্তু এর পেছনে যে কত মানুষের রুটিরুজির সংস্থান হয় সে হিসাব আমরা রাখি না। শ্যানেল হাউস, এই শো তাদের বার্ষিক আয়োজনের অংশ হিসেবে ২০০২ সালে শুরু। ১৩ বছর পেরিয়ে বর্তমানে প্রতিবছর এই আয়োজনের নেপথ্যে কাজ করে দুই হাজার মানুষ।
তারায় তারায় খচিত ফ্যাশন মচ্ছব শুরুর আগে দেখানো হয় লেগারফেল্ড লিখিত, পরিচালিত ও নির্মিত কোকো শ্যানেল বায়োপিক ‘ওয়ান্স অ্যান্ড ফরএভার’। ক্রিস্টেন স্টুয়ার্ট ও জেরাল্ডাইন চ্যাপলিন অভিনয় করেন নাম ভূমিকায়-তরুণ ও প্রৌঢ়।
লেগারফেল্ড ফ্যাশনের একজন গল্পকথক। সবাই যেখানে শেষ করেন, তাঁর শুরু সেখান থেকেই। প্রতিবছর, ১৩ বছর ধরে তিনি এটাই করে চলেছেন। বয়স তাঁর কাছে কখনোই তাই বাধা হয়নি। তাঁর মস্তিষ্ক কখনোই শূন্য হয়নি। তিনি একজন আপাদমস্তক স্রষ্টা। কাপড়ের ক্যানভাস নয় কেবল সেই পোশাকের উপস্থাপনার নাড়িনক্ষত্রও থাকে তাঁর নখদর্পণে। এ জন্যই তো টি ম্যাগাজিনে তাঁর প্রোফাইল লেখক, অ্যান্ড্রু হোগান তাঁকে বর্ণনা করেছেন, একজন ডিজাইনার নয় গ্র্যান্ড ফিল্ম ডিরেক্টর হিসেবে।
এই ফ্যাশন শোকে মডেলদের তিনি হাঁটিয়ে ক্ষান্ত থাকেননি। বরং পুরোনো দিনের ইতালিয়ান ছবির বেশ কয়েকজন দিয়েছেন অভিনেত্রীর লুক। তাঁদের উপস্থিতি সবাই ফিরিয়ে নিয়ে গেছে ফেলে আসা দিনে। এটাই আসলে তাঁর হোমেজ টু প্যারিস, এটাই তাঁর রোমান হলিডে। দুয়ে মিলে একাকার। আর তা কীভাবে করতে হয় সেটা আবারও দেখিয়ে দিলেন এই কালজয়ী মহাস্রষ্টা। বললে অত্যুক্তি হবে না, লেগারফেল্ডের এই ফ্যাশন মহাকাব্য উপস্থাপনার মধ্য দিয়েই পর্দা নেমেছে শেষ হয়ে আসা বছরের ফ্যাশনের আলোকোজ্জ্বল মহামঞ্চে।
লেখক : সাংবাদিক ও লাইফস্টাইল প্রফেশনাল