দেশি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে শীর্ষ অবস্থানে ‘হিলস’
ফেসবুকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় দেশীয় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম হিল ই-কমার্স সোসাইটি (Hill E-Commerce Society—HILLES) এখন ৩০ হাজার সদস্যের একটি প্রাঙ্গণ। এখনও তার বয়স পাঁচ মাস হয়নি। এর মধ্যে এটি দেশব্যাপী বেশ আলোচনায় এসেছে। বেশ কয়েকজন লাখপতি সেলার বেরিয়েছেন এই হিল ই-কমার্স সোসাইটি থেকে।
এ বিষয়ে গ্রুপের এডমিন মনি পাহাড়ী বলেন, ‘হিল ই-কমার্স সোসাইটি-হিলস দেশীয় কমন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম। এর চেয়ে সংখ্যায় বড় গ্রুপ রয়েছে। সেগুলো দেশি-বিদেশি সব পণ্য নিয়ে কাজ করছে এবং ভালো পারফর্ম করছে। তবে দেশি পণ্য নিয়ে কাজ করার পেছনে আমাদের বেশ কিছু যুক্তি রয়েছে। আমাদের দেশের অসাধারণ অনেক সৃষ্টি রয়েছে। সেগুলো বাইরের পণ্যের চাকচিক্যের ভিড়ে হারিয়ে যাক সেটা চাই না। আমাদের দেশের টাকা বাইরে না গিয়ে অন্য দেশের টাকা এদেশে আসবে সেটা স্বপ্ন ছিল। আশাব্যঞ্জক বিষয় হচ্ছে এই কাজটি ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।’
সংখ্যাগত দিক থেকে অল্প সময়ে দেশি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের কমন ই-কমার্স গ্রুপের শীর্ষে চলে এসেছে ‘হিল ই-কমার্স সোসাইটি’। এই অর্জনের পেছনের কারণ সম্পর্কে মনি পাহাড়ী বলেন, ‘আমাদের মূল উদ্দেশ্য পাহাড়ের অনবদ্য সৃষ্টিগুলোকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করানো। সেখানে পণ্য যেমন রয়েছে তেমনিভাবে এখানকার প্রকৃতি, জনজীবন ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরা নিয়েও কাজ করছি আমরা। এতে পাহাড়ের প্রতি দারুণ আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে সবার। পাহাড়ের পাশাপাশি সমতলের ঐতিহ্যবাহী নানানকিছু রয়েছে এখানে। পাহাড়কে জানছে সমতল আর সমতলকে নিবিড়ভাবে দেখছে পাহাড়। পরস্পরের মধ্যে অদ্ভূত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এই সম্পর্কটাই হিল ই-কমার্সের সবচেয়ে বড় শক্তি। আরও অনেক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত আছেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু দিনশেষে ঘরে ফেরার আনন্দ নিয়ে কাজ করেন তারা হিলে। এখানে শুধু পণ্য নিয়ে গল্প হয় না। আমাদের কাভারে অধিকাংশ সময় জুড়ে থাকে পাহাড়ের প্রকৃতি ও জনজীবনের ছবি। এতে মানসিক প্রশান্তি পান ক্রেতা, উদ্যোক্তা, শুভাকাঙ্ক্ষী সবাই।
মাত্র পাঁচ মাসেই বেশ কয়েকজন লাখপতি সেলার বেরিয়েছেন হিল ই-কমার্স সোসাইটি থেকে। এটাও একটা বড় অর্জন। এর পেছনের কারণ এখানে ক্রেতা উদ্যোক্তা সমান মর্যাদায় অবস্থান করেন। লাখপতি সেলার যেমন রয়েছেন, সেভাবে লাখপতি বায়ারও আছেন আমাদের।
আমরা কঠিন ভাষায় কথা না বলে সহজ যোগাযোগ স্থাপনের জন্য মাঝে মধ্যে বিনোদনের আয়োজন করি। মাসপূর্তিতে গ্রুপ ডেভেলপ করা নিয়ে কথা বলি। কথার মাঝে গান হয়। গল্প হয় ফেসবুক লাইভে। ফলে আরও কাছের হয় সম্পর্কগুলো। এভাবে আমরা এক হয়ে যাই।’ বলছিলেন মনি পাহাড়ী।
হিল ই-কমার্স সোসাইটিতে বেশকিছু টিম কাজ করছে। তার মধ্যে সিনিয়র মডারেটর হিসেবে রয়েছেন ননিকা চাকমা, মাফরুহা চৌধুরী, ভানতংকুং বম, মেহনাজ রহমান লিরা, রুমানা খানম, জান্নাত আরা ঝুনু, দীপ্তা দেওয়ান, বি. জামান রিপিট, সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা ও পিটম চাকমা। মডারেটর হিসেবে আছেন ইলোরা সুলতানা, এস এফ জ্যোতি, ঊর্মি গোস্বামী নীড়, নব কুমার, হুমায়রা ঐশী, শামীমা হক, লায়লা কামরুন নাহার, মোহাম্মদ মাজেদুল হক ও আইশা চাকমা।
পরিচালক হিসেবে রয়েছেন কামরুজ্জামান রঞ্জু, সফিক পাহাড়ী, রূদাবা রায়হান, মনিরুল হক, জুয়েল বড়ুয়া ইমন, রন্ত কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, রেজাউর রহমান রিজভী, ইকবাল আহমেদ জনি, রিপন খান, ধ্রুব হাসান বিপ্লব সরকার, শম্পা হক, সোহানা পারভীন, আলমগির কবীর, ফারজানা ববি, রুবেল মিয়া, শিখা চাকমা, তাহসিন রহমান ও আশিক সুমন।
লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে আছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাবিব রাব্বানী উচ্ছ্বাস। এর বাইরেও তরুণ একটা টিম কাজ করছে। তাদের মধ্যে বেশ সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন সাফায়েত মজুমদার হিমেল, স্বপ্না চাকমা, মহিউদ্দিন সজীব, রুবিনা বেগম, আইশি চাকমা, লিলি, খুশি ডুং কেপি, নাহার মুন্নী, ঝুমুর, তাসনিয়া পাখি, উম্মে হাবিবা বৃষ্টি, কিশোর তঞ্চঙ্গ্যা আমু, সাদমান খান, সাদমান সাকিব, এলি চাকমা, আফরোজা সাদিয়া, কানিজ রুমকি, মো. সুমন সরকার, ইয়োংসাঙ্গি সীমা, তানিয়া সারোয়ার, টিপরা জ্যাক, মনীষা চাকমা, সুশান্ত চাকমা ও মিনু খেয়াং।
এর বাইরেও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে হিলে বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিথযশা বেশ কয়েকজন মানুষ যুক্ত রয়েছেন এবং যুক্ত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। পাহাড়ের প্রতি বিশেষ টান জাগিয়ে তোলায় বড় ভূমিকা রাখছে হিল ই-কমার্স সোসাইটি।
মনি পাহাড়ী বলেন, ‘আগামীতে হয়তো পার্বত্য চট্টগ্রামে আরও অনেক দেশি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম হবে। তারা সবদিক থেকে ছাপিয়ে যাবে আমাদের। সেইদিনের স্বপ্ন দেখি। আমরা চাই চলাটা হোক সুন্দর আর মিষ্টি সম্পর্কময়।’
হিল ই-কমার্স সোসাইটি নিয়ে কথা হয় সিনিয়র মডারেটর ননিকা চাকমার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘হিল ই-কমার্স সোসাইটি একটি দেশীয় পণ্যের প্ল্যাটফর্ম। আমি এর জন্মলগ্ন থেকেই এর সঙ্গে জড়িয়ে আছি। হিল গঠনের শুরুতে আমাদের প্রধান দুটি উদ্দেশ্য ছিল। ১. বিশ্বের দরবারে দেশীয় পণ্যকে তুলে ধরা এবং ২. দেশের সব জেলার মানুষকে এক প্ল্যাটফর্মে একত্রিত করে সৌম্যভাব গড়ে তোলা।
ননিকা চাকমা বলেন, ‘আমরা যারা পাহাড়ে বেড়ে উঠেছি আর যারা সমতলে বেড়ে উঠেছে সবার মধ্যে একটা মেলবন্ধন সৃষ্টি করাই হিলের উদ্দেশ্য। এখানে শুধু পণ্যের কথা হবে না, হবে শিল্প সংস্কৃতি নিয়েও আলোচনা। যার মাধ্যমে আমরা সব সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাব। সমতলের অনেকেই পাহাড়ের জীবনযাত্রা, খাবারদাবার নিয়ে কিছুই জানতো না। হিলের মাধ্যমে তারা অনেক কিছুই জানতে পারছে।
ননিকা চাকমা বলেন, ‘আর আমি মনে করি, ই-কমার্স হলো সম্ভাবনাময় এবং স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ সৃষ্টিকারী একটি প্ল্যাটফর্ম। অনেকেই আছেন যাদের ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করার সুযোগ নাই, তারা ঘরে বসেই নিজের একটা পরিচিতি গড়ে তুলতে পারছেন এবং আত্মনির্ভরশীল হতে পারছেন। আমি নিজেও কখনো চিন্তা করিনি এমন কিছু করব যা আমার পরিচিতিকে আরো বাড়িয়ে দেবে। এটা সম্ভব হয়েছে একমাত্র ই-কমার্সের মাধ্যমে।’
“মডারেটর প্যানেলে এমন কিছু তরুণ উদ্যোক্তা আছেন, যারা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন নিজেদের শ্রম এবং মেধা দিয়ে। হিলকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আর একটা কথা না বললেই নয়, সেটা হলো নেতৃত্ব। কোনো কাজে সঠিক নেতৃত্ব না থাকলে সে কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করা খুবই কঠিন। বলা যায় অসম্ভবও। হিল গ্রুপের অ্যাডমিন মনি পাহাড়ী একজন দক্ষ নেতা। তাঁর নেতৃত্বে হিল খুব কম বয়সেই যে সাফল্য অর্জন করেছে সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমরা যারা উনার সঙ্গে কাজ করি, তাদের উদ্দেশ্যে তাঁর সব সময় পরামর্শ থাকে, ‘হিলে পোস্ট করতে যেন উদ্যোক্তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে পরিবেশ যেন আমরা বজায় রাখি। সবার সঙ্গে সম্পর্ক যেন হয় প্রাণবন্ত। কাউন্সিলিংটাই যেন প্রাধান্য পায় বেশি।’ কারণ সবাই সব কাজে দক্ষ নয়। হিলের উদ্যোক্তাদের দক্ষ করে গড়ে নেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় মডারেটর প্যানেলের ওপর। আমি বিশ্বাস করি, হিল একদিন তার স্ব-মহিমায় বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।” বলছিলেন ননিকা চাকমা।