বিজয়ের মাস
কারো জন্য অপেক্ষা করেনি মুক্তিযুদ্ধ
বিজয়ের মাস এলেই কিছু কথা মনে এসে ভর করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর আমাদের চলমান রাজনীতির মধ্যে একটি একটি দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আমাদের রাজনীতিতে একটি কূট ঝগড়া আছে স্বাধীনতার ঘোষক প্রশ্নে। ইতিহাস লিখন পদ্ধতিতে বলা হয়, ইতিহাস পদবাচ্য হবে দুই প্রজন্মের আগে পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনা। পঁচিশ বছরে এক প্রজন্ম ধরলে পঞ্চাশ বছর পরের ঘটনা ইতিহাসে জায়গা পাবে না। এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনে একটি বড় অর্জন বলে কিছুটা আপস করে আমরা একাত্তর পর্যন্ত ইতিহাস লিখি। পঞ্চাশ বছরের সীমারেখা টানার যৌক্তিক কারণ আছে।
ইতিহাসের ঘটনার সঙ্গে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে থাকেন, তাঁদের অনেকেই স্বাভাবিক নিয়মে হয় মৃত্যুবরণ করেন, নয়তো অবসর জীবনে চলে যান। ফলে বর্তমানের ইতিহাস লেখক ইতিহাস রচনার পদ্ধতি অনুসরণ করে এবং তথ্যসূত্র পর্যালোচনা করে তাঁর আলোকে নির্মোহভাবে ইতিহাস রচনা করেন। ইতিহাসের ঘটনার জন্ম যাঁরা দেন, তাঁরা সেই ইতিহাস রচনা করলে তাকে নিরপেক্ষ রাখা কঠিন বলেই এই ব্যবস্থা। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্কের ফয়সালা ইতিহাসের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরের দিকে দৃষ্টি বুলাই। এতে অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যেতে পারে।
প্রথম প্রহর বলতে ২৫ মার্চের কালরাতের সূচনা। পাশ্চাত্যের হিসাবে যা ২৬ মার্চে গড়ায়। মানতেই হবে ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরও যখন বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি শাসকরা নানা টালবাহানা করছিল, তখন থেকেই বাঙালি মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল পাকিস্তান নামের দেশ থেকে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর একটি স্বাধীন দেশের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে পড়েছিল তাঁরা। পাকিস্তানি শাসকরা যে এক ভয়ংকর মুক্তিযুদ্ধ চাপিয়ে দেবে তা হয়তো কেউ তেমনভাবে ভাবতে পারেনি। তবে যে কোনো প্রতিরোধের জন্য মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল বিশেষ করে তরুণ সমাজ। চট্টগ্রাম বন্দরের ডকশ্রমিকরা যখন জানল পাকিস্তান থেকে অস্ত্রবোঝাই জাহাজ এসেছে, তখন কাউকে নির্দেশ দিতে হয়নি। শ্রমিকরাই বেঁকে বসেছিল এ অস্ত্র জীবন থাকতেও তারা খালাস করবে না।
বাঙালি তাদের কল্পনায় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিল বলেই নতুন কোনো ঘোষণার অপেক্ষা করেনি। নিজেরাই স্বাধীনতার স্মারক পতাকা বানিয়ে ফেলেছিল। লাল-সবুজ পতাকা। লাল সূর্যের মাঝখানে বাংলাদেশের হলুদ মানচিত্র। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। দেশের সর্বত্র পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানোর রেওয়াজ। একাত্তরের এই দিনে কারো নির্দেশ ছাড়াই পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ বাঙালি (আলবদর-রাজাকার মানসিকতার বাঙালি ছাড়া) তাদের বাড়িতে, অফিস আদালতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে দেয়। পাড়া-মহল্লায় তরুণরা বাঁশের লাঠি বানিয়ে মার্চপাস্ট করতে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর থেকে সচেতন বাঙালি ভয়ংকর কোনো ঘটনা ঘটার আশঙ্কা করছিল। তাই পুরো ঢাকা শহরে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার ওপর গাছের গুঁড়ি, গ্যারেজে থাকা ভাঙা গাড়ি প্রভৃতি ফেলে ব্যারিকেড দিচ্ছিল যাতে সেনাবাহিনীর যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু কেউ আঁচ করতে পারেনি পাকিস্তানি জান্তা গোপনে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে গণহত্যার এক ভয়ংকর নীলনকশা প্রস্তুত করে ফেলেছে।
স্থানীয় তরুণ যুবক ও সাধারণ মানুষ ফার্মগেটের রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছিল। রাতভর পাহারা দেবে। রাত ১২টায় পাকবাহিনীর ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। কিন্তু সময় এগিয়ে রাত সাড়ে ১১টায় সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে সাঁজোয়া যান। ব্যারিকেডের পাশে দাঁড়িয়ে তরুণরা মুহুর্মুহ স্লোগান দিচ্ছিল ‘জয় বাংলা’। সার্চলাইটের তীব্র আলো ফেলে সামরিক যানের বহর এগিয়ে আসছে রাস্তা কাঁপিয়ে। কী নেই সেই বহরে। ট্যাংক, কামান, ভারী মেশিনগান সব কিছুতেই সজ্জিত। বহর কাছে আসতেই প্রতিবাদের ভাষায় উচ্চকণ্ঠে জয় বাংলা স্লোগান দেয় তরুণরা। উত্তর আসে মেশিন গানের বিরতিহীন গুলিতে। এই প্রথম ফার্মগেটের রাজপথ রঞ্জিত হয়ে যায় স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালির রক্তে। মিলিটারি কনভয়ের একটি দল এগিয়ে চলে পিলখানার দিকে। তখন এটি ইপিআরের সদর দপ্তর। বাঙালি সৈন্যরা আছে সেখানে। ফুটপাতে ঘুমন্ত খেটে খাওয়া নিরীহ মানুষদের হত্যা করতে করতে আর পথের পাশের বাড়িঘরে আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে ওরা পৌঁছে যায় পিলখানায়। বাঙালি অফিসার আর জওয়ানরা কোনো ঘোষণার অপেক্ষা করেননি। বিশাল রণসাজে সজ্জিত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সামান্য রাইফেল নিয়েই প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেশ-মায়ের জন্য অকাতরে জীবন দেন। অনেকে বৃহত্তর যুদ্ধে অংশ নেওয়ার তাগিদে অস্ত্র হাতে বা অস্ত্র রেখেই আত্মরক্ষা করে এলাকা থেকে সরে যান।
পাকবাহিনীর আরেকটি দল ঘেরাও করে ফেলেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। ছাত্ররা সেখানেও প্রায় খালি হাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ২৫ মার্চের মাঝরাতের প্রথম প্রহরে সবচেয়ে বড় সম্মুখযুদ্ধ হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। থ্রি নট থ্রি রাইফেল যাদের প্রধান সম্বল সেই বীর পুলিশ সদস্যরাও মুক্তির মন্ত্রে উদ্বেলিত। ট্যাংক, কামান, মেশিনগান নিয়ে সহস্র পাকসেনা ঘিরে ফেলেছে রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তর। এখানে যুদ্ধ হলে তা হবে নিতান্তই অসম যুদ্ধ। হয় আত্মসমর্পণে অনিশ্চিত যাত্রা নয়তো জেনেবুঝে আত্মাহুতি। এই মুহূর্তে নতুন কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালি পুলিশের সামনে ছিল না। এর প্রয়োজনও ছিল না। বীর পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা তথাকথিত দিকনির্দেশনার অভাবে হতাশ হয়ে পড়েননি। স্বাধীনতার মন্ত্রে বলীয়ান রাজারবাগের বাঙালি পুলিশ সদস্যরা নিজেদের করণীয় স্থির করে ফেলেছিলেন। নিজেদের সামান্য অস্ত্র নিয়েই যতক্ষণ প্রাণ ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়ে গিয়েছিলেন। বুকের রক্তে মুক্তিযুদ্ধের সূচনাযাত্রা এভাবে শুরু হয়ে যায়।
কদর্য রাজনীতি ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিকে কখনো রুদ্ধ করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত আড়াল করা যায় না ইতিহাসের সত্য। মুক্তিযুদ্ধ না দেখা প্রজন্মকে হয়তো চন্দ্রগ্রহণের মতো সাময়িক প্রচ্ছায়ায় বিভ্রান্ত করা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ দেখা জ্ঞানপাপী সুবিধাবাদীরা হয়তো চতুরতার সঙ্গে সত্য আড়াল করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে চাইবে। কিন্তু এমন দুঃসময় কখনো স্থায়ী হয় না। অচিরেই প্রচ্ছায়া কেটে গ্রহণমুক্ত হয় চাঁদ। সুবিধাবাদী রাজনীতি সব সময়ই ইতিহাসের সত্য আড়াল করতে চায়। নানা উপায়ে তারুণ্যকে চায় বিভ্রান্ত করতে। তবে আমরা মনে করি বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই বিভ্রান্তি ক্ষণস্থায়ী। যে প্রজন্মের পূর্বসূরিরা স্বাধীনতার জন্য বুলেটের সামনে অকুতোভয় ছিলেন। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করেছেন। তাঁদের উত্তরসূরিদের রক্তে আলোড়ন উঠবেই। রাজনীতির হীনস্বার্থের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে ম্লান হতে দেবে না। যার যেখানে যতটা সম্মান অথবা ঘৃণা পাওয়ার তা ইতিহাস নির্ধারণ করেই রেখেছে। তবে মানতে হবে বিজয়ের চুয়াল্লিশ বছর পরও এদেশের আকাশে দুষ্ট রাজনীতির ছড়িয়ে দেওয়া গ্রহণ এখনো কাটেনি। এই প্রজন্মের সামনে যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর গৌরব আরো স্পষ্ট হবে, তখন এরাই অপচ্ছায়া তাড়ানোর আরেক মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়