অন্ধকারে আলোর উৎস আকবর আলি খান
আকবর আলি খান। যিনি এক জীবনে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে জ্ঞানেগুণে হয়েছেন কীর্তিমান। একাত্তরে প্রত্যক্ষ যুক্ত থেকে, সমাজ, রাষ্ট্র-প্রশাসনের অভিজ্ঞতায় হয়ে উঠেছেন অনন্য। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। সকল খোলস চুরমার করে, গতানুগতিক ভাবনা ভেঙে গড়েছেন আলোর ইমারত। সত্যান্বেষীরা একবাক্যে বলছেন আকবর আলি খান কুণ্ঠাহীন-সত্যবাদী একজন যুধিষ্ঠির। যার কাছে আলোহীন আমলা, শিক্ষক, রাজনীতিক, সাংবাদিক কিংবা ভাড়ায় খাটা বুদ্ধিজীবীদের ভয়ে ভিড়তেন না। কিন্তু নতুন ও অজানাকে জানার আগ্রহী তারুণ্যের ভিড় ছিল আমৃত্যু চারপাশে।
আমি আকবর আলি খানকে জানি এক যুগের বেশি সময়। কিন্তু কথা বলার সুযোগ বা প্রসঙ্গ আসেনি। চলতি বছরের ২ মার্চ কথা হয়। আত্মজীবনীমূলক বই ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ নিয়ে। বইমেলা চলছে; একটা বিশেষ সাক্ষাৎ প্রয়োজন। সময় দিলেন অত্যন্ত আন্তরিকতায়। প্রশ্ন করলাম, আমরা দেখি দেশে অনেকে আত্মজীবনী বড় বড় করে প্রকাশ করে। এতে দেখা যায় ব্যক্তি অনেক তথ্য আড়াল করেন। অথচ পুরোনো পত্রিকা, মানুষ তাঁকে অন্যভাবে জানে। এ বিষয়ে কী বলবেন? জবাবে বললেন, ‘আমার মনে হয়, আমি অকপটে যা বলার বলেছি, কিন্তু তবুও লোকের মনে প্রশ্ন হতে পারে আড়াল কতটা করেছি। কেউ বলবে, আমি আত্মপ্রচারের জন্য কিছু বলেছি। এটাই আত্মজীবনীর বড় সমস্যা। আত্মজীবনী লিখলে লোকে সন্দেহ করে; মনে মনে বলে বোধহয় আত্মপ্রচারের জন্য লিখেছে। এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আত্মজীবনীতে কিছুটা হিপোক্রেসিও থাকে। আমি তা করিনি, এখন লোকে যদি পড়ে আনন্দ পায়, সেটাই সার্থকতা।’
আমি তাঁকে প্রশ্ন করি, আপনি ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বর্ণনা করেছেন বইতে। অনেক আগের তারিখ, সাল ব্যবহার করেছেন। সেগুলো কীভাবে যাচাই করেছিলেন? উত্তরে যা বলেছেন, তাতে আমি সন্তুষ্ট। একই সঙ্গে তাঁর সততা লক্ষ করার মতো। তিনি বলছেন, ‘পুরোনো তারিখগুলো অন্যান্যদের আত্মজীবনী, পত্রিকা থেকে নিয়েছি। বাকি কিছু তারিখ আছে যেগুলো মুক্তিযুদ্ধের বইপত্র থেকে নেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের টালমাটাল দিনগুলো স্পষ্ট মনে আছে। অসহযোগ আন্দোলনের কথা লিখেছি। আর আমি চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব নির্ভুল করার জন্য। তারপরেও হয়তো কিছু ভুল হতে পারে, কেউ ধরিয়ে দিলে সেটা বইয়ের পরবর্তী সংস্করণে পরিমার্জন করে দেব।’
এই হচ্ছেন একজন লেখক-গবেষক-সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তক আকবর আলি খান। এমন কথা বলার লোক খুব কম। সত্য প্রকাশে অন্যরা যেখানে দ্বিধান্বিত, তিনি সেখানে এক পায়ে খাড়া।
খ.
সাহিত্যিক-সাংবাদিক-রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদের বই ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইটির বাংলাদেশ সংস্করণ ৫০ বছরে পা দিচ্ছে ২০২২ সালে। এই নিয়ে একটা যথাযথ আলোচনা কে রাখতে পারেন। এ বিষয়ে পরামর্শ চাইতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন ‘আকবার আলি খান বেস্ট’। আমি আর দেরি করলাম না। মার্চের সম্পর্কের সূত্রে আবুল মনসুর আহমদপুত্র দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনামের সঙ্গে আকবর আলি খানের বাসায় যাই ৬ আগস্ট। তিনিও আমাদের পেয়ে খুশি। তার কদিন পর তাঁর শাশুড়ি জাহান আরা রহমানের শততম জন্মদিন। ব্রিটিশ ভারত, দেশভাগ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কালপর্বের সাক্ষী তাঁকে নিয়ে গল্প করেন।
১ সেপ্টেম্বর ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর : পাঠ ও পর্যালোচনা’ শীর্ষক আলোচনায় প্রধান আলোচক হিসেবে থাকবেন বলে জানান। সঠিক সময়ে চলে আসেন, দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনা করেন। ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ এত মোটা বই থেকে নোট নিয়েছেন, যা অত্যন্ত কঠিন কাজ। প্রায় ৪০০ মানুষের উপস্থিতিতে আলোচনা করেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে।
সাহসের সঙ্গে উচ্চারণ করেন, ‘দেশে পরোক্ষ গণতন্ত্রকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে রূপান্তর করতে হবে। কারণ, পরোক্ষ গণতন্ত্রে বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হয়। নির্বাহী বিভাগ, সংসদ, বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন করতে হবে। এখন দেশের সব রাষ্ট্রীয় অঙ্গ নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বে রয়েছে। নির্বাহী বিভাগের এ ধরনের কর্তৃত্ব থাকলে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটে।’
আবুল মনসুর আহমদের লেখার সঙ্গে একমত পোষণ করে আকবর আলি খান বলেন, ‘আমি একটু বিস্মিত হয়ে গেছি, আমি বেশ কিছুদিন ধরেই এ কথাগুলো বলে আসছি। আমি মনে করেছি, এগুলো আমার বক্তব্য। দেখলাম, আমি আবুল মনসুর আহমদের বক্তব্যই প্রচার করছি। আমাদের সংবিধানে চারটি স্তম্ভ আছে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। আমার বক্তব্য হলো, যে দেশে গণতন্ত্র নেই, সে দেশে টেকসইভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা চালু করা সম্ভব নয়।’
কেবল এই প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে নয়, তিনি সারাজীবনই পড়ে বলেছেন, গবেষণা করে লিখেছেন। চিন্তা করে মতামত দিয়েছেন। সব সময় সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়েই কথা ছড়িয়ে দিয়েছেন। ভেবেছেন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায়। তবে ব্যক্তিগত জীবনের কথা তেমন বলতেন না। লিখেছেন অল্প কিছু বই। তাঁর বইগুলোর বিষয়বৈচিত্র্যে রয়েছে অর্থনীতি, রাজনীতি, দারিদ্র্য, বাজেট। ভিন্নভাবে আবিষ্কার করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দের বনলতা সেনকে। ‘বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য : একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ’ আনেন। অর্থাৎ অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য—যেকোনো বিষয়ে তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। অনেক জটিল বিষয়ও সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন।
নিজের লেখালেখি নিয়ে বলেন, ‘পণ্ডিতদের জন্যই লিখি বা সাধারণ পাঠকদের জন্য লিখি না কেন, সব বইয়ের পেছনে রয়েছে অনেক বছরের চিন্তা ও ভাবনা। বনলতাকে নিয়ে দুটি বই লিখেছি। বনলতাকে নিয়ে চিন্তা শুরু করি ১৯৬৮ সালে। বই প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে।’
গ.
আকবর আলি খান প্রসঙ্গে খ্যাতিমান রুশ লেখক নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির কথা সামনে আসছে। নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি তেরো বছর বয়সে একটি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হন, যা তাঁকে পরবর্তীতে কিছুদিনের মধ্যেই অন্ধ এবং শয্যাশায়ী করে দেয়। এ অবস্থায় তাঁর জীবনের প্রথন উপন্যাস ‘হাউ দ্য স্টিল ওয়াজ টেম্পার্ড’ লেখেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘ইস্পাত’। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর উপন্যাস ‘বর্ন অব দ্য স্টর্ম’ শেষ করে যেতে পারেননি।
আকবর আলি খানও ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’র দ্বিতীয় খণ্ড শেষ করে যেতে পারেননি। তবে দ্বিতীয় খণ্ড প্রসঙ্গে আগেই জানিয়েছেন, ‘দ্বিতীয় খণ্ড হয়তো আমার মৃত্যুর পর ছাপতে হবে। কেননা, এই বইয়ে এমন কিছু থাকবে, যা অনেকে সহ্য করতে পারবেন না।’ এখন অপেক্ষা আমাদের দ্বিতীয় খণ্ডে কী আছে!
মৃত্যুচিন্তা ও আত্মমূল্যায়ন প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করি। মৃত্যুর ওপর তো আমার কোনো হাত নেই। তবে মৃত্যু নিয়ে আমি ভয় করি না। ভয় করি না এ জন্য যে, আমি আমার বিবেকের বিরুদ্ধে কখনো কোনো কাজ করিনি। এ জন্য আমি মনে করি আমাকে যখনই কোনো জবাবদিহিতার জন্য হাজির করা হবে আমার বিবেকের আলোকে যতটুকু সম্ভব সেটা হয়তো আমি ব্যাখ্যা করতে পারব।’
এমন মানুষ আমরা কোথায় পাব আর? কত দ্রুত হারালাম তাঁকে। ১ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) আকবর আলি খান সর্বশেষ বক্তৃতা করেন। পরের বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টায় নিজ বাসায় হার্ট অ্যাটাক করেন। কিন্তু অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই দেখেছেন এই বয়সেও তিনি নোট নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা প্রজন্মের সবার জন্য শিক্ষণীয়। অনুসন্ধানী চোখ মাত্র জানেন, তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাষ্ট্রভাবনা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় লিখেছেন। শ্রদ্ধা হে কীর্তিমান। অন্ধকারে আলোর উৎস একজন আকবর আলি খান।