আদর্শের মৃত্যু নেই, ক্ষয় নেই
আজ ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। ইতিহাসের নৃশংস ও মর্মস্পর্শী রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের দিন আজ। ১৯৭৫ সালের এই দিন শুধু একজন মানুষ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার-স্বজনদের হত্যার ঘটনাই ঘটেনি, ঘাতকেরা সেদিন জাতির চেতনাকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু ঘাতকেরা তা পারেনি। কারণ, বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন। বঙ্গবন্ধু একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি দেশ, একটি বিপ্লব, একটি অভ্যুত্থান এবং একটি ইতিহাস। সেদিন খুনিরা তাঁকে হত্যা করতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু তাঁর আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ফল হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে দেখলে বঙ্গবন্ধুকে দেখা যায়। তিনি আজও বেঁচে আছেন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। রাজনীতির লক্ষ্য অর্জনে ত্যাগই ছিল বঙ্গবন্ধুর পথ। ত্যাগের মহিমা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কথা, ‘যেকোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, তারা জীবনে কোনো ভালো কাজই করতে পারে নাই’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১২৮)। তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পেরেছিলেন, ‘জীবনে আমার অনেক দুঃখ আছে সে আমি জানি, সে জন্য নিজেকে আমি প্রস্তুত করে নিয়েছি’। (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ১৭৩)
বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের প্রায় পুরোটা সময় ত্যাগ করেছেন। এমনকি তাঁর জীবনটাকেও তিনি ত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও এর জনগণের সার্বিক কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর জীবন ছিল উৎসর্গীকৃত। তিনি ছিলেন আজীবন মানবদরদি। শোষণ-বঞ্চনার অবসানই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। সেটা যেমন জাতি হিসেবে বাঙালির, তেমনি স্বতন্ত্রভাবে প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেও। পুরো জীবন দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন তাঁর রাজনীতি ছিল মানুষের কল্যাণে। একটি স্বাধীন ও সমৃদ্ধশালী জাতি হিসেবে বাঙালির মুক্তি চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর নাম নিয়ে মানুষ যুদ্ধ করেছে, বিপুল ত্যাগ স্বীকার করেছে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সব হিংস্রতা ও বর্বরতাকে মোকাবিলা করেছে। যুদ্ধের নয়মাস মানুষ ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ এই একটি স্লোগান দ্বারাই সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিজীবনে, রাজনীতিবিদ হিসেবে, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর উদার আদর্শের অসাধারণ সকল নমুনা রেখে গেছেন। তিনি ভোগে বিশ্বাসী ছিলেন না। যার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন একাধিকবার মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে। জাতির পিতা কখনো তাঁর নিজের বা তাঁর পরিবারের দিকে তাকাননি। যার প্রমাণ পাওয়া যায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে। একজন মানুষ যিনি তাঁর ৫৫ বছরের জীবনে প্রায় ১৩ বছর জেলে ছিলেন। দিনের পর দিন পরিবারকে সময় দিতে পারেননি, নিজে পরিবারের সান্নিধ্য পাননি। আরাম-আয়েশ-বিলাস কী জিনিস, তিনি জানতে পারেননি। মানুষের জন্য, জনগণের জন্য, জাতির জন্য তাঁর কাজ করার আকুলতা খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর দেওয়া বক্তব্যে। তিনি নিজ কণ্ঠেই বলে গেছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, বাংলার মানুষের মুক্তি চাই।’ এ আদর্শই তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রতিটি মুহূর্তে। রাজনীতিতে ত্যাগ এবং মানবসেবাই ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল আদর্শ। পৃথিবীর ইতিহাস বলে একজন রাজনীতিবিদ বা নেতাকে হত্যা করে তাঁর আদর্শ কিংবা দর্শন হত্যা করা যায় না। তাই ১৫ আগস্টেও ওই হত্যাকাণ্ড বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ছুঁতে পারেনি। যদিও ঘাতকেরা আদর্শকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। এ জন্য শিশু রাসেলকেও নির্মমতা থেকে রেহাই দেয়নি।
একজন মানুষের মধ্যে যত ধরনের গুণাবলি থাকা সম্ভব, বঙ্গবন্ধুর মাঝে তার সবগুলোই ছিল; যে কারণে বঙ্গবন্ধু আজও আমাদের মাঝে উজ্জ্বল, চিরভাস্বর ও স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। ক্ষমা, দয়া ও দানশীলতা বঙ্গবন্ধুর অন্যতম মহৎ গুণ। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ছিল ঐন্দ্রজালিক মহাশক্তি। তিনি সফল স্বপ্নদ্রষ্টা, রাজনীতির মহান কবি; তাঁর ভাষণে ছিল অমৃতময় কাব্যিক ব্যঞ্জনা, বাংলা ভাষণে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাগ্মী। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও বাঙালি জাতির পিতা।
মানুষ হিসেবে, একজন বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন কত গভীর ছিল, রাজনীতিক কুশীলব হিসেবে তিনি মানুষের ভালোবাসার সঙ্গে নিজেকে কতটা সম্পৃক্ত করেছিলেন, প্রকৃতপক্ষে তা-ই তাঁকে অমর করে রেখেছে। তাঁর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র শুরুতেই তাঁর সেই পরিচয় পাই। তিনি বলেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’
বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা, যিনি একই সঙ্গে বাঙালির অতীত ও ভবিষ্যৎকে তাৎপর্যপূর্ণ করেছেন। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের পথিকৃৎ হিসেবে মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রাম করে বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে আজও তিনি মিশে আছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর অমর কীর্তি। তাই যতদিন বাংলার মানচিত্র থাকবে, যতদিন বাঙালির ইতিহাস থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু থাকবেন অমর-অবিনশ্বর। বাংলার স্বাধীনতা, ভাষা, সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালিরূপে বঙ্গবন্ধু থাকবেন চিরজাগ্রত। তিনি যে আদর্শ তৈরি করে গেছেন, তার কোনো মৃত্যু নেই, ক্ষয় নেই। দ্য টাইমস অব লন্ডন-এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ বলা হয়, ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সব সময় স্মরণ করা হবে। কারণ, তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।’ একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়