আমাদের ভাস্করদা
কামরুজ্জামান ভাস্কর। ভাস্করদা আমাদের দীর্ঘদিনের সহকর্মী। মৃদুভাষী, হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটির সাথে আমাদের প্রথম পরিচয় অ্যানিমেশন শিখতে গিয়ে ২০০২ সালে। তার পর থেকে ২০২১ পর্যন্ত নানা ভাবে নানা সময়ে ভাস্করদার সাথে কাজ করেছি। খুব কাছ থেকে দেখবার ও চেনার সুযোগ হয়েছে এনটিভিতে কাজ করার সময়। দীর্ঘ রোগভোগের পর সম্প্রতি চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে।
সহকর্মী হিসেবে এই রোগভোগের সময়টায় একজন প্রাণবন্ত মানুষকে ধীরে ধীরে আমরা নিঃশেষ হয়ে যেতে দেখলাম, দেখলাম মৃত্যু কীভাবে মানুষকে গ্রাস করে। শেষ দিকে, তিনি যখন সামনে এসে দাঁড়াতেন, অসম্ভব অসহায় লাগত, চোখে চোখ রাখতে পারতাম না, মনে মনে ভাবতাম, যে মানুষটি কারও দুঃখের কথা শুনলে হাহাকার করে উঠতেন... বলতেন... আর বলো না... প্রকৃতি তাঁকেই এত কষ্ট কেন দিচ্ছে। ইচ্ছে করে হাসিঠাট্টা করতাম, যাতে তাঁকে হাসানো যায়, তাঁর এই হাসিটাই ছিল আমাদের এক ধরনের আত্মতৃপ্তির জায়গা। ভাবতে ভালো লাগত যে আর কিছু পারি না পারি, কিছুটা সময় তো তাঁকে মৃত্যুর ছায়া থেকে দূরে রাখা গেল।
মাঝে মাঝে চিন্তা করতাম, এমন কোনও ক্ষমতা মানুষের থাকলে ভালো হতো, যা দিয়ে দুঃখ-যন্ত্রণা ভাগ করে নেওয়া যায়, তাহলে পরিচিত সবাইকে বলতাম, আসুন, সবাই তাঁর যন্ত্রণা একটু করে নিয়ে নিই।
আমরা সবাই জানি যে একসময় চলে যেতে হবে, প্রতিটি মুহূর্ত চলে যাচ্ছে আর আমরা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এটা যেন একটা অদৃশ্য স্টপওয়াচের মতো, দেখা যায় না কিন্তু অনুধাবন করা যায়। আর যে মুহূর্তে কেউ দেখে ফেলে তার স্টপওয়াচটা, সে মুহূর্ত থেকে জীবনের সব অর্থ মনে হয় পাল্টে যায়। কথাগুলো আমাদের নয়, ভাস্করদার।
দীর্ঘ সময়ের কত স্মৃতি আজ চোখের সামনে ভাসছে, তাঁর হাসি, কথা বলা, যন্ত্রণার কথা, টুকটাক আরও কত কী। অর্থহীন, অনর্থক কত কথা মনে পড়ছে, যার কোনও মানে নেই। এনটিভির গ্রাফিক্স রুমে টানা বারো বছর কত কত স্মৃতি... কোনটা রেখে কোনটা বলব। না, কোনও স্মৃতিচারণ করতে চাই না। আমাদের কাছে স্মৃতি খুব ব্যক্তিগত অনুভূতির ব্যাপার, বিশেষ করে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের বিষয়ে। তবে তাঁর কিছু বিশেষ গুণের কথা বলি। মানুষকে খুব উৎসাহিত করতে পারতেন, সব ব্যাপারে সাহায্য করার চেষ্টা করতেন, কাজকে খুব অ্যাপ্রিসিয়েট করতেন আর টেকনিক্যাল গেজেটের প্রতি ছিল অসম্ভব আগ্রহ। আমাদের গ্রাফিক্স রুমের এমন কেউ নেই যার টেকনিক্যাল গেজেট কিনতে তিনি যাননি। মাঝে একদিন বলে ফেললাম, ভাই আপনি তো নতুন কোনও গেজেট হাতে পাইলে বাচ্চা পোলাপানের মতো করেন। শুনে হাসলেন, বললেন, আদনান, এইটাই আমারে এখনও বাঁচায় রাখছে, তুমি বুঝবা না। আর ভালোবাসতেন অ্যানিমেশন। বলতেন, আবার যদি অ্যানিমেশনের একটা স্টুডিও বানাতে পাড়তাম... হাহাকার করতেন। ক্যারেক্টার অ্যানিমেশন সহজ পাঠ থেকে জটিল পাঠ, সবই তাঁর হাতে পাওয়া। শিক্ষক হিসেবে খুব ধৈর্যশীল ছিলেন তিনি। নানা ভাবে আমি তাঁর কাছে ঋণী। ঋণপূরণ বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ তিনি দিলেন না। বৃষ্টি পছন্দ করতেন, বৃষ্টি শুরু হলেই দেখার জন্য আমার ডেস্কের পেছনে দাঁড়াতেন আর বলতেন কী সুন্দর কী সুন্দর। আদনান চল নিচে, বৃষ্টি দেখে আসি। আমি বেরসিকের মতো বলতাম, এসি রুমে বসে বসে বৃষ্টি দেখেন। মনে পড়ে কষ্ট হচ্ছে... তিনি আর কোনও দিন নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়াবেন না। বলবেন না, চল বৃষ্টি দেখি।
কাছের আত্মীয়, প্রিয়জন আর বন্ধু হারানোর কষ্টগুলো আমাদের কাছে পরিচিত, কিন্তু দীর্ঘ সময়ের সহকর্মী হারানোর কষ্টটা কেমন, সেটা জানতাম না। ভাস্করদার মৃত্যু আমাদের সহকর্মী হারানোর কষ্টকর অনুভূতি দিল। শেষ দিকে শরীর বেশি খারাপ হওয়ায় অফিসে আসেননি। মৃত্যুসংবাদ জানার পরে মনে করতে চেষ্টা করলাম, তাঁর সাথে শেষ কথাগুলো কী ছিল। অদ্ভুত মানুষের মন, কিছু মনে করতে পারলাম না। মাথায় ঘুরতে থাকল একটাই কথা, আমি খুব কষ্ট পাইতেছি, এখন মরলে বাঁইচা যাই। ভাস্করদা, এই দুনিয়ায় অনেক কষ্ট করে গেলেন ভাই, এ বার ভালো থাকুন পরম করুণাময়ের কাছে।