আলোকিত মানুষ নিলুফার মঞ্জুর
অল্প দিনের দেখায় কম পরিচিত একজন মানুষকে অনেক কাছে দেখা আমার জীবনে ভিন্ন স্বাদের সন্ধান দিয়েছে। জীবনের অনেকটা সময় পাড়ি দিয়ে এসেছি। কিন্তু নিজেকে প্রশ্ন করছি, এমন নিবেদিত প্রাণ এমন নিরহংকারী এমন নির্ভেজাল এমন সৎ এমন হাসিখুশি এমন নমনীয় এমন জ্ঞানী এমন পরিশ্রমী এমন অমায়িক এমন আরো অনেক গুণে ভূষিত যিনি, তিনি আর কেউ নন, তিনি সদ্য প্রয়াত বাংলাদেশের ইংরেজি মাধ্যম স্বনামধন্য সান বিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মিসেস নিলুফার মঞ্জুর, যাঁকে সবাই মিসেস মঞ্জুর নামেই জানেন ও চেনেন। তাঁর সংস্পর্শে কেউ না এলে গভীর সমুদ্রের মতো যাঁর জ্ঞান ও গুণের পরিধি, তার তিল পরিমাণও অনুধাবন করা সম্ভব হতো কি? আমি এই স্বল্প সময়ের দেখায় কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেছি।
উনার পরিচয়ের আর একটু ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। তিনি বাংলাদেশের বিখ্যাত শিল্পপতি এবং বাংলাদেশ সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর সহধর্মিণী। কী অপূর্ব চরিত্রের একজন প্রাণবন্ত সত্যিকারের মাটির তৈরি একজন মানুষ! একটু আগে উনাকে প্রয়াত লিখতে গিয়ে আমার হাতটা কেঁপে উঠেছিল। কারণ করোনার কারণে লকডাউনের কদিন আগে আমার সঙ্গে উনার এক সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না উনি নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে উনার অবদানের তুলনা আমার দৃষ্টিতে মনে হয় উনি নিজেই। আমার চোখে পড়েনি এমন অসামান্য ব্যক্তিত্বের মানুষ, যাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ জাতির জন্য বিশাল মূল্য বয়ে এনেছে। উনি আমাদের মাঝে নেই। জাতি হারাল একজন মাকে, যে মা তাঁর প্রতিটি সন্তানকে সত্যিকারের মানুষ বানানোয় অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন, যেখানে সামান্যতম ভুল বা অবহেলা উনার ছিল না। উনি সদা সচেতন নাগরিক ছিলেন। মিসেস মঞ্জুরকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে এতগুলো জমা কথা কেমন করে গুছিয়ে লিখব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। মহান আল্লাহতালার দরবারে আমাদের সবার প্রার্থনা, তিনি যেন তাঁর এই প্রিয় বান্দাকে যদি কোনো ভুল ত্রুটি থাকে সব মাফ করে দিয়ে তাঁর জন্য বেহেশত কবুল করেন এবং ওই দুনিয়ায় শান্তিতে রাখেন। আমি ভাগ্যবতী, এমন বিরল গুণের একজন মানুষের সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ হয়েছিল।
মিসেস মঞ্জুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সমসাময়িক ছিলেন। উনি শ্রেণির দিক থেকে আমার চেয়ে দুই বছর এগিয়ে ছিলেন। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিংয়ে আমরাই প্রথম ছাত্র-ছাত্রী ছিলাম। মিসেস মঞ্জুর অর্থনীতির ছাত্রী ছিলেন। উনি রোকেয়া হলে ছিলেন না বলে আমার সঙ্গে কোনোদিন আলাপ হয়নি। পরে আমি উনাকে সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখেছি। ঢাকা ক্লাবে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর সঙ্গে উনাকে দেখেছি, কিন্তু আলাপ কখনো হয়নি। আমি বর্তমানে উত্তরায় বাস করি। আমার মেয়ে নওরিন আমার কাছাকাছিই থাকে। ওর ছেলেকে স্কুলে দিতে হবে এবং সে ঠিক করেছে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াবে আর সান বিমসেই ভর্তি পরীক্ষা দেওয়াবে। সান বিমসের মূল শাখা উত্তরাতে। ২০১৪ সালে আমার নাতি রায়াতের বয়স দুবছর চার মাস। প্লে গ্রুপের বয়স সাড়ে তিন বছর, তার মানে বাচ্চাদের ভর্তি পরীক্ষা এক বছর আগে নেওয়া হয় এবং পরীক্ষা মানে মৌখিক পরীক্ষার সঙ্গে বাবা-মায়েরও ইন্টারভিউ নেওয়া এবং উত্তীর্ণ হলে এক বছর আগেই ভর্তি করানোর নিয়ম। কেবল চব্বিশজন বাচ্চাকে নেওয়া হবে। আমার নাতি মহাভাগ্যবান, এই নামকরা স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল। আমার নাতির সৌভাগ্যের সঙ্গে আমারও সৌভাগ্যের দরজা খুলে গেল। আমি চমৎকৃত হতে লাগলাম ২০১৫ সাল থেকে। সত্যি কথা এ স্কুলের প্রতিটি ইটের সঙ্গে কথা বলেছি আর মুগ্ধ হয়েছি। মনে মনে ভেবেছি এই শহরের আর একটি স্কুল কি এই স্কুলটির সমমাপের হবে? আমি স্কুলটির কোনো ত্রুটি খুঁজে পাই না।
আমি প্রায় প্রতিদিনই রায়াতকে স্কুল থেকে আনতে যাই। স্কুলের পরিবেশ, নিয়মকানুন, স্কুলের অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীর আচরণ, স্টাফদের ব্যবহার, টিচারদের অসাধারণ নিয়মানুবর্তিতা, সবকিছু আমাকে এতটাই মুগ্ধ করেছে যে আমি স্কুলে গেলেই এমন আদর্শ এমন সফল স্কুলের মূল কারিগর মিসেস মঞ্জুরকে খুঁজতাম। শুধু এই ধ্রুবতারাকে উনার নিরলস পরিশ্রমের সফল অর্জনকে উনার কানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। আর আমি নিজেও উনার সঙ্গে পরিচিত হতে চেয়েছিলাম। আমি নিজেও একটি খ্যাতনামা স্কুলে অনেক বছর চাকরি করেছি। আমি নিজেও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। আমার ছেলেমেয়েরাও বিশেষ বিশেষ স্কুলে লেখাপড়া করেছে। সব স্কুল আমার কাছে বিশেষ অসাধারণ মনে হয়নি। কিন্তু সান বিমস আমার দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। এই স্কুলটাতে কোনো রাজনীতির ছোঁয়া নেই, কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে স্কুলের প্রতিটা ছাত্রছাত্রী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। আমি অবাক না হয়ে পারিনি, এটা কী করে সম্ভব! আমি যখনই মিসেস মঞ্জুরকে দেখতাম কী অমায়িক হাসিখুশি ভদ্র অত্যন্ত নমনীয়ভাবে সবারর সঙ্গে আচরণ করতেন। প্রত্যেকের মুখে উনার প্রশংসা শুনতাম। আমার স্কুলটাকে ব্যতিক্রম ভাবার একটাই কারণ যেটা আমি আমার জানামতে কোনো স্কুলেই দেখিনি, ক্লাসের প্রতিটি বাচ্চাকে প্লে গ্রুপ থেকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। এই ব্যাপারটা একেবারেই অসাধারণ। আমি শুনিনি কোনো টিচার কোনো বাচ্চার সঙ্গে কখনো কোনো অশোভন আচরণ করেছেন। পিছিয়ে পড়া বাচ্চাকে আলাদা সময় দিয়ে মেকআপ করার চেষ্টা করেন। এসবই মিসেস মঞ্জুররের অতি ভদ্রভাবে আদেশ এবং নির্দেশ ছিল অন্য শিক্ষকদের প্রতি। আমি এমনটাও কোনো স্কুলে দেখিনি বার্ষিক অনুষ্ঠানগুলো দুটো ক্লাস করে করে ক্লাসের প্রতিটি বাচ্চাকে ইনভলব করিয়ে এক মাস ধরে রিহার্সেল করিয়ে ১০-১২ দিন লাগিয়ে কী চমৎকার করে অনুষ্ঠানগুলো করতে। আমরা অভিভাবকরা দারুণ উপভোগ করতাম, কারণ আমাদের নিজেদের বাচ্চারাও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত। এমনটাও দেখিনি অন্য কোথাও, প্রত্যেক ছাত্র বা ছাত্রী তার বাবা-মা ছাড়া আরো চারজন অতিথি ওদের অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য আমন্ত্রিত হতো। আমি স্বল্প সময়ে অনেক কিছু লক্ষ করেছি। তার মধ্যে প্রত্যেক বাচ্চাকে সমানভাবে মূল্যায়ন করে ওদের দিয়ে অনুষ্ঠান করিয়ে ওদের ভেতর আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা। এটা সাধারণ ব্যাপার নয়। একাডেমিক সাইড সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের ক্যাপাসিটি অনুযায়ী এ বি সি গ্রেড পাচ্ছে। এই ছোট ছোট বাচ্চাদের জ্ঞানের গভীরতা দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। আমি ভেবেই পাই না এই বয়সে আমি ওদের জ্ঞানের ধারেকাছেও ছিলাম কি না! অনুষ্ঠান শেষে মিসেস মঞ্জুর সবার উদ্দেশে চমৎকার মনোমুগ্ধকর বক্তব্য রাখতেন। আমরা পিনপতন নীরবতায় উনার বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। উনি বাচ্চাগুলোকে দ্বিগুণ উৎসাহ দিয়ে প্রশংসা করতেন, যাঁরা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন তাঁদের প্রশংসা করতেন, উপস্থিত অতিথিরা ধৈর্য ধরে সময় ব্যয় করে বাচ্চাদের অনুষ্ঠান উপভোগ করে তাদের উৎসাহ দিয়েছেন, তার জন্য উনি বিনয়ের সঙ্গে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন।
আমি এমন নিরহংকার চৌকস শিক্ষাবিদ দেখিনি। আমি সুযোগ খুঁজে বেড়াতাম কেবল উনার অসামান্য ভূমিকা শিক্ষাঙ্গনে কতটা মূল্য বহন করছে, এর খানিকটা আঁচ তাঁর সামনে তুলে ধরার জন্য। বলতেন উনি—কী যে বলেন, আমি কী এমন করলাম। আমি বলতাম, আপনি কী করছেন তা আপনি নিজেও জানেন না। আমি উত্তরে পেয়েছি বিনয় আর মিষ্টি হাসি। এমন মানুষের জন্ম কালেভদ্রে হয়। উনার জন্য বরাদ্দ সময় এইটুকুই ছিল। চির অম্লান চির অমলিন একটা চেহারা। আমার সঙ্গে উনার শেষ দেখা গত ফেব্রুয়ারিতে বারিধারায় একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে সালাম বিনিময় করতে আমি উনার কাছে গেলাম, সেই চিরাচরিত হাসি যেন কত কালের চেনা! বললাম, ম্যাডাম আমি কাল আপনার বেশ কয়েকটা ছবি ফেসবুকে দেখেছি। উনি আকাশ থেকে পড়ার মতো হতভম্ব! বললেন, আমার ছবি কে আবার দিল? বললাম, আপনার বন্ধুরা দিয়েছে। আপনার বন্ধুদের মধ্যে একজন আমার কাজিন, সে আবার আমার ফেসবুক বন্ধু। নাম কী বলেন? বললাম, উনি সেভাবে মনে করতে পারছিলেন না। উনার আর এক বন্ধু ওখানে ছিল তিনি মনে করিয়ে দিলেন। তখন উনার সব মনে পড়ল আর খুব প্রাণ খুলে হাসলেন। আমি বললাম, আমার নাতি তো আপনার স্কুলে পড়ে। বললেন, নাম কী, কোন ক্লাসে পড়ে, ধানমণ্ডি না উত্তরায়? বললাম, রায়াত, ক্লাস ওয়ান, উত্তরা। ওইভাবে মনে করতে পারলেন না। বললেন, দেখলে তো চিনবই। হেসে দুজন দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আমার সঙ্গে সম্পর্কের একটা চমৎকার হাসির রেশ, যা আমার হৃদয়ের গভীরে যত্নে জমা হয়ে রইল। উজ্জ্বল একটি ধ্রুবতারা আমার হৃদয়ে জ্বলবে, যেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আমার সামনের দিনগুলোতে ছোট ছোট বাচ্চারা, যারা আমার সংস্পর্শে আসবে, তাদের মিসেস মঞ্জুররের অমর বাণীগুলো পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। মহান সৃষ্টিকর্তা মিসেস নিলুফার মনজুরকে সহি সালামতে রাখবেন। আমি কচি কচি সান বিমসদের উদ্দেশে বলছি, তোমরা এখনো বুঝে উঠতে পারোনি কী মহামূল্যবান রত্ন তোমরা হারিয়েছ, তোমরা এখনো অনেক ছোট। আমার বিশ্বাস, যে শিক্ষার বীজ মিসেস নিলুফার মঞ্জুর রোপণ করে দিয়ে গেলেন, সেই চারাগাছগুলো তাঁর উত্তরসূরিরা অনেক যত্ন নিয়ে লালন-পালন করবেন। আর বড় হবে তোমরা মানবিক গুণাবলী দিয়ে তোমাদের হৃদয়ের ভাণ্ডার পূর্ণ করে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেবে তোমাদের জ্ঞানের আলো। মিসেস মঞ্জুর, তোমাদের প্রাণপ্রিয় প্রিন্সিপাল, ওপার থেকে দেখবেন উনার বাচ্চারা পৃথিবীজুড়ে জ্ঞান ও কর্মের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্যে বিজয়ী হয়ে বিচরণ করছে। তোমাদের অসামান্য সাফল্যে আমাদের সবার প্রিয় শ্রদ্ধেয় মিসেস নিলুফার মঞ্জুররের আত্মা শান্তি পাবে! মিসেস নিলুফার মঞ্জুররের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার লাইন তুলে ধরছি—‘যেতে আমি দিব না তোমায়।/তবুও সময় হল শেষ, তবু হায়/ যেতে দিতে হল’...
লেখক : প্রাক্তন শিক্ষক (ইংরেজি বিভাগ), ভিকারুন্নিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা