নির্বাসনের দিনগুলো ও হৃদয়বিদারক ১৫ আগস্টের কালো রাত
দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় আমরা বর্ডার পাড়ি দিই। এবার আমরা মেহেরপুর দিয়ে যাই। মেহেরপুরের সাবেক এমপি সহিউদ্দিন সাহেবের বাসায় আমরা আশ্রয় নিই। তাঁর ছেলে ফরহাদ হোসেনের (বর্তমান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী) সঙ্গে আমি দুটি কুকুরের বাচ্চা লালু-ভুলুকে নিয়ে খেলা করি। ফরহাদ আমাদের বয়সী ছিল।
সব ধরনের যানবাহনেই চলতে হয়েছিল বর্ডার পার হতে গিয়ে। গরুর গাড়ি, নৌকা, এমনকি রাতের অন্ধকারে হেঁটে ডোবানালাও অতিক্রম করতে হয়েছিল। সবচেয়ে কষ্ট হয়েছিল গরুর গাড়ি চড়া, ছাউনিওয়ালা গরুর গাড়ি। গরুর গাড়িতে অনেক ঝাঁকি খেতে হয়, মাথায় আঘাত লাগে। আমি কান্নাকাটি করছিলাম, আর সহ্য করতে পারছিলাম না। দাদি আর রেখা ফুফু (ছোট ফুফু) আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন যে, ‘আর একটু পথ, এই তো চলে এসেছি।’
কিন্তু পথ আর শেষ হয় না। সহ্য করেছিলাম শুধু জেনে যে ওপারে পৌঁছালে বাবা-মাকে পাব। তখনো আমরা জানি না যে, বাবা-মা নেই। আমাদের বলা হয়েছিল, বাবা-মা আহত হয়েছে। চিকিৎসার জন্য বিদেশে আছে। ওপারে পৌঁছালে সেলিম কাকা আর মারুফ কাকা আমাদের বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে যাবে।
এমনকি ছোট্ট তাপসও আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। বলছিল, ‘পরশ দাদা, আরেকটু কষ্ট করো। ওপারে গেলেই সেলিম কাকা, মারুফ কাকা আমাদের বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে যাবে।’ ওটাই ছিল আমার আর তাপসের একমাত্র ভরসা, একমাত্র আশার সম্বল।
ঠিক বর্ডারের কাছেই আমরা একটা চরের মতো জায়গায় আশ্রয় নিলাম। চারদিকে থৈথৈ পানি; ঘন অন্ধকার রাত। আমরা অনেক ভয় পেয়েছিলাম। জায়গাটা ছিল অত্যন্ত দুর্গম। আমাদের সঙ্গে সেলিম কাকা নজরুল নামের একটা লোক ঠিক করে দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক আমাদের সম্পূর্ণ সহায়তা করেছেন। উনি না থাকলে হয়তো বা আমরা আসতেই পারতাম না। একটা সময় ইঙ্গিত এলো যে এখন ফাঁকা আছে, আমাদের দৌড় দিতে হবে। তাপসকে কোলে নিয়ে আমরা রাতের অন্ধকারে দৌড় দিলাম। হাঁটু পর্যন্ত পানি অতিক্রম করে আমরা বর্ডারে পৌঁছালাম।
বর্ডারে একটা অফিসে আমাদের বসানো হলো। ওখানে উর্দি পরা মানুষজন ঘোরাফেরা করছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে অনেকক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হলো। তবে ওরা অনেক আদর-যত্ন করেছে। আমাদের নাশতাও খেতে দিয়েছিল।
সেলিম কাকা আর হাসনাত মামাকে দেখে আমাদের আনন্দ আর ধরে না! আমরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। আমাদের সব কষ্টের পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং আমাদের বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে যাবে। আমাদের আর পায় কে? সেলিম কাকা আর হাসনাত মামাও আমাদের বুকে জড়িয়ে ভীষণ কান্না করছিলেন। তাঁদের কান্না দেখে আশপাশের সবার চোখেই পানি এসেছিল সেই দিন।
তাঁরা আমাদের কলকাতার বাঙ্গর নামক এলাকায়, সিন্ডারেলার বাসায় নিয়ে এলেন। বাসাটা সংলগ্ন সিন্ডারেলা নামে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল। এ কারণেই বাসাটা সিন্ডারেলার বাসা নামে পরিচিত। ওই বাসায় আমরা দুই ভাই বাবা-মাকে পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি, সেখানে চাচি, মামি, কান্তা আপু ও শিশু সাদেকও (বর্তমান বরিশালের মেয়র) আছে।
কান্তা আপু আমাদের থেকে দু-তিন বছরের বড়। এ ছাড়া ওখানে তত দিনে বেশ কিছু আমাদের বাংলাদেশি আত্মীয়স্বজন, যাদের হয়রানি করছিল মোশতাক সরকার বিভিন্নভাবে, তারাও পালিয়ে এসেছিল। অনেকে ছিল, কিন্তু বাবা-মা ছিল না।
আস্তে আস্তে আমাদের না পাওয়ার যন্ত্রণা সয়ে আসছিল কিনা, জানি না। কিন্তু আমার মধ্যে এক ধরনের বিরক্তি কাজ করছিল। আমি যেন বাবা-মাকে চাইতে চাইতে আর না পাইতে পাইতে অতিষ্ঠ। জিদ করে বাবা-মায়ের কাছে যেতে চাওয়াও কমিয়ে দিই একসময়। তবু অবচেতন মনে একটা আশা ছিল, হয়তো বা বাবা-মা আসলেই লন্ডনে আছেন। কারণ, আমাদের সেটাই বলে সান্ত্বনা দেওয়া হতো। আমি মনে হয়, ১৯৭৯ সালে দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত আশা করতাম, বাবা-মাকে কোনো একদিন ফেরত পাব। একসময় বুঝতে পারলাম যে বাবা-মা লন্ডনে থাকার কথাটা একটা অবাস্তব কল্পনা।
যেহেতু এক বাসায় বেশি মানুষ হয়ে গিয়েছিল, কিছু মাস পরে আমরা বাসা বদলি করে আর একটা বাসায় উঠি। ছোট্ট একটা তিন রুমের একতলা বাসা। পাশেই দুই কামরার অন্য একটা বাসা। ওখানে আরেকটা পরিবার থাকত। দুই বাসার মাঝখানে শুধু কলাপসিবল গেটের একটা দেয়াল। ওখানে এক সনাতন ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করত। ভদ্রলোক চাকরিজীবী ছিলেন, নিয়মতান্ত্রিক এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। মৃদুভাষী ওই ভদ্রলোকের নামটা আমার মনে নেই, তবে তাঁর স্ত্রী তন্দ্রা কাকি আমাদের পড়াতেন এবং অনেক আদর করতেন। তাঁদের দুই সন্তান নান্টু আর মালি। মালি আমার বয়সী হবে, আর নান্টু আমার থেকে দু-এক বছরের বড় হবে। শিগগিরই ওদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওদের প্রতি মাসেই কোনো-না-কোনো ধর্মীয় উৎসব থাকত। প্রথমটাতে যাওয়ার পরে আমার লোভ হয়ে গেল। আমি তার পর থেকে সব পূজার উৎসবে যেতে বায়না ধরতাম। দাদি ভয় পেতেন, যেতে দিতে চাইতেন না। আমিও জিদ করতাম। চাচি দাদিকে বুঝিয়ে ব্যবস্থা করে দিতেন। পূজা উৎসবগুলোর গানবাজনা আর আনন্দমুখর পরিবেশ আমার কাছে অসম্ভব ভালো লাগত।
কান্তা আপুও মাঝেমধ্যে আসত। আমরা একসঙ্গে খেলা করতাম। একদিন আমি, কান্তা আপু, তাপস আর নান্টু একটা অভিযানে বের হলাম; আমরা চিরাচরিত গণ্ডি পেরিয়ে দূরে যে দমদম বিমানবন্দর দেখা যায়, ওখানে যাব। আমরা মাঠঘাট পেরিয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। আমি সবার আগে আগে দৌড়াচ্ছিলাম। সামনে দেখি, কালো চকচকে নিচু একটা পিচঢালা জায়গা। পা দিতেই হঠাৎ করে আমি অনুভব করলাম, আমি কাদায় পা দিয়েছি। কিন্তু কাদা থেকে পা উঠাতে পারছি না।
দেখলাম যে যতই চেষ্টা করছি, আমি কাদার ভেতরে আরো ঢুকে যাচ্ছি। এরই মধ্যে কান্তা আপু, তাপস আর নান্টু এসে দেখে আমি প্রায় কোমর পর্যন্ত ঢুকে গিয়েছি। তাপস আমার এই অবস্থা দেখে কেঁদেই ফেলল। ওর কান্না দেখে আমিও কান্না শুরু করলাম। কান্তা আপু আর নান্টু আমাদের মধ্যে বড়। এরা দুজন আমাকে ওঠানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। যেহেতু আমরা অভিযানের জন্য শর্টকাট পথ বেছে নিয়েছিলাম, জায়গাটা ভীষণ জনশূন্য ছিল। অনেক কসরত করে ওরা আমাকে চোরাবালি থেকে উদ্ধার করল। আমাকে তুলতে গিয়ে নান্টুর একটা পাও চোরাবালিতে পড়ে গিয়েছিল। পা ওঠাতে গিয়ে ওর স্যান্ডেলটা খোয়া যায়। এই ছিল আমার জীবনের প্রথম অভিযানের ফলাফল, আর দাদির কথা অবাধ্য হওয়ার শাস্তি। ফেরার পথে আমরা সবাই খুবই ভীত এবং মন খারাপ করছিলাম।
স্যান্ডেল হারিয়ে নান্টুর কী পেরেশানি! স্যান্ডেল জোড়া গত মাসে পূজার সময় ওর বাবা কিনে দেন এবং সামনের বছরের পূজার আগে ওকে আর স্যান্ডেল কিনে দেওয়া হবে না। এই হচ্ছে ওর ডিলেমা। কথাটা শুনে আমি বুঝতে পারিনি প্রথমে। পরে বুঝলাম যে, ওর বাবা চাকরিজীবী, সীমিত আয়। তাই আর এক জোড়া স্যান্ডেল কিনতে ওর সামনের বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই নিয়মটা আমাকে ভাবায় এবং অবাকও করে।
লেখক : ১৫ আগস্টের শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি ও আরজু মনির জ্যেষ্ঠ পুত্র, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান