নেতা শেখ মুজিব
স্ট্রং লিডার বা শক্তিশালী নেতৃত্ব সব সময়ই প্রশংসার বিষয়, দুর্বলতা পরিত্যাগযোগ্য। সততা, সাহস, নিজেকে প্রকাশের ক্ষমতা, বিচারক্ষমতা, নানান মত গ্রহণের ক্ষমতা, ভালো স্মৃতিশক্তি, সাহস, দূরদর্শিতা, সীমাহীন উৎসাহ এবং চিন্তাভাবনায় কট্টর না হয়ে আধুনিক ও নমনীয় হওয়া—এ সবই ভালো নেতা হওয়ার গুণ।
নেতার গ্ল্যামার, ক্যারিশমা, জনপ্রিয় জনমোহিনী শক্তি সবই ছিল বঙ্গবন্ধুর। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণটিকে বিশ্লেষণ করতে গেলে নেতার যে বৈশিষ্ট্যের কথা বলি আমরা, তার সবই প্রকাশিত হয়। আজ থেকে চার বছর আগে এই ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। এ ধরনের দলিলগুলো যে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়, সে তালিকায় এ ভাষণটিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণ, যা বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে, এখন সারা বিশ্বের সম্পদ।
ভাষণের বিশ্লেষণ করতে গেলে বারবার যেন বঙ্গবন্ধুই উঠে আসেন প্রতিটি শব্দে। ম্যাক্স ওয়েরার বলেছিলেন, “A politician has to overcome a quite vulgar vanity, the deadly enemy of all matter of fact devotion to a cause and of distance forwards ones self”.
বঙ্গবন্ধু এ ভাষণের মাধ্যমে একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, অন্যদিকে পাকিস্তান ভাঙারও দায়িত্ব নেননি। ফলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছুই করার ছিল না। বঙ্গবন্ধুর কৌশল ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী না হয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা। সেদিন তিনি সফল হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী ছিলেন, ভাষণে তিনি একদিকে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, অন্যদিকে সুকৌশলে চারটি শর্তের বেড়াজালে শাসকের চক্রান্তকে আটকে দিলেন এবং সামরিক শাসকদের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করার পাতানো ফাঁদেও পা দিলেন না। একদিকে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ যেমন বললেন; তেমনই চার শর্তের জালে ফেললেন শাসকদের সব ষড়যন্ত্রকে।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, তিনিই নেতা, যিনি ময়দানে সামনে এগিয়ে লড়াই করেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বাংলাদেশে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন গড়ে ওঠে, ২৫ মার্চের পর যা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ যেমন স্বাধীনতা আর মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন, তেমনই ২৫ মার্চ পাকিস্তানিদের আক্রমণের মুখে পালিয়ে যাননি। বুক পেতে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন, যেমনটা করেছেন ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট।
মাত্র ১৭ মিনিটের ভাষণে সেদিন বঙ্গবন্ধু যেমন আমাদের দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের পটভূমি তুলে ধরেছেন, তেমনই দেশবাসীর করণীয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এককথায় বলা যায়, এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল। তিনি বললেন, সামরিক শাসন তুলে নিতে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে এবং আন্দোলনে নিহতদের বিষয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এ ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল, যখন তিনি বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকবেলা করো।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’।
জীবন ও রাজনীতিতে পূর্ণ শৃঙ্খলায় বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু চাইতেন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীবিরোধী এমন আন্দোলন পরিচালনা করতে, যেখানে আন্দোলনের উত্তুঙ্গ অবস্থাতেও সর্বোচ্চ নেতার আদেশে আন্দোলনকারীরা প্রয়োজনে নিজেদের আবেগ সংহত রেখে চলবে। সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলনের বাস্তবতা অবশ্য এতটা পরিকল্পনামাফিক চলে না। কিন্তু নেতা শেখ মুজিব কখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিজেকে তাঁর বাংলার মানুষকে নেননি।
বঙ্গবন্ধু মানুষের প্রিয় ছিলেন। কারণ তাঁর জনপ্রিয়তাবাদের কেন্দ্রে ছিল বাংলার মানুষ। মানুষের জন্যই সব সময় বিচলিত ছিলেন তিনি। ৭ মার্চের ভাষণে বারবার তিনি বলেছেন, ‘বাংলার মানুষ’ শব্দ দুটি।
তারকাসুলভ রাজনৈতিক নেতা খুব বেশি তো পায়নি বাংলাদেশের বাঙালি। এই মানুষটি নিঃসন্দেহে সেই গৌরবময় অভিধার একমাত্র দাবিদার। বাংলার মাটি কাঁপিয়ে ন’মাসের তীব্র যুদ্ধ শেষে যে স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা, তার প্রধান কারিগর তিনিই। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থেকেও তিনিই ছিলেন আমাদের নেতা।
চলছে তাঁর জন্মশতবর্ষ। বঙ্গবন্ধু ভাঁজ করা পাঞ্জাবি ও চকচকে জুতা পায়ের নেতা ছিলেন না। মাঠেঘাটে ঘাম ঝরিয়ে রাজনীতি করা মানুষ। নিজেকে কখনও মানুষের উপরে ভাবেননি। মানুষের মধ্যে মিশে, মানুষের আবেগের সঙ্গে নিজের আবেগকে ওতপ্রোত জড়িয়ে রাজনীতি করেছেন বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনীতির টেবিলে দেশ সৃষ্টি করেননি মুজিব। অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষের তরে রক্তকণিকা আর অশ্রুজল দিয়ে দেশ সৃষ্টির সংগ্রাম করেছেন বঙ্গবন্ধু। মুজিবের রাজনীতিতে মিশে আছে কোটি মানুষের চোখের জল, লাখ লাখ মানুষের দেহের রক্ত।
একটা দেশকে লড়াইয়ের জন্য তৈরি করা সহজ কথা নয়। ২৩ বছরের সংগ্রাম আর ত্যাগ করা মানুষকে, যেন পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ এক ভাষণে। এ দেশের মানুষের লড়াইকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন মুজিব যে বাংলাদেশ তৈরির লড়াইকে গোটা বিশ্বের কাছে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন হিসেবে দেখানোর জন্য পাকিস্তানিদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। পুরো বিশ্বই আমাদের লড়াইকে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবেই দেখেছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি অবধি পাকিস্তানি কারাগারের বন্দিত্ব নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘সে দিন আপনি কেন ধরা দিলেন?’ বঙ্গবন্ধুর উত্তর ছিল, তিনি ধরা না দিলে তাঁর খোঁজে আরও অনেক লোককে খুন করা হতো, আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ভারতের ক্রীড়নক বলে প্রমাণ করার চেষ্টা চলত। এটাই নেতৃত্ব, এটাই দূরদৃষ্টি।
পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি থাকায় বাংলার মানুষের মনে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ যেমন ছিল, তেমনই তাঁকে এক বিশাল প্রতীক ভেবে নিয়ে জানপ্রাণ লড়াই করেছে মানুষ। পুরো নয় মাস মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনের লড়াইয়ে জয় বাংলার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর নাম ধরে উচ্চারিত হতো যুদ্ধের স্লোগান : ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’।
লেখক : সাংবাদিক