সুবর্ণজয়ন্তী
পরান দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালি
যে বাতিঘরের অবাক আলো জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে রাখে হাজার মানুষের মনের ঘরে, সেই বিদ্যায়তনের আজ পঞ্চাশতম জন্মজয়ন্তী। আজ তো পাখির কলকাকলিতে আনন্দধামের সব বাসিন্দার ঘুম ভাঙবার কথা ছিল। আকাশের বিজলিতে হওয়ার কথা ছিল পঞ্চাশবার তোপধ্বনি। ফুলের রঙিন পাপড়িতে উড়বার কথা ছিল প্রাণোচ্ছল প্রজাপতির। নৃত্য-গীত বাদ্য-বাজনা আর পুণ্য প্রার্থনায় নিভৃত ক্যাম্পাস হয়ে উঠবার কথা ছিল প্রাণচঞ্চল।
কিন্তু অতিমারির এই অকাল এনেছে বিচ্ছেদের বিয়োগব্যথা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীর কাছে আবেগমথিত ভালোবাসার অপর নাম। অথচ ঘরের সন্তানেরা আজ ঘরহারা। কিন্তু মনটা কি প্রবোধ মানে? তার বসত জাহাঙ্গীরনগরের প্রাণের পরে। আজ না হয় বিরহেই কাটল নিশিদিন। সেই বিরহ অনল হয়ে প্রেমের দীপটাও কি জ্বালল না?
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাবীকালের মনের কথা পড়তে পেরেই তো প্রেমের কাগজে প্রাণের কলমে লিখে রেখেছিলেন—
কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো।
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
ডাকিছে মেঘ, হাঁকিছে হাওয়া,
সময় গেলে হবে না যাওয়া,
নিবিড় নিশা নিকষঘন কালো।
পরান দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালো।
বিরহানলে পুড়ে পুড়ে আজ আমাদের নবজন্মের আঁতুড়ঘরে পরান দিয়েই প্রেমের দীপ জ্বেলে রাখলাম।
ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাস, লাল সিরামিকের ইট আর লাল মৃত্তিকা, জলভরা পুষ্করণীর জলপিপি আর সরালিরা, ঝোপের ধারে যেখানে টিলার আড়াল, সেখানকার লুকায়িত শৃগাল-গুঁইসাপ, তার ওপর ছায়াদানকারী জারুল, সোনালু, কৃষ্ণচূড়া কিংবা রাধাচূড়া আর বাংলা ভাষা ও মহান স্বাধীনতার স্মারক সংশপ্তক, অমর একুশে ও শহিদ মিনার এক হয়ে আজ আনন্দের সুর সাধছে। মুক্তমঞ্চ, টিএসসি, ছায়ামঞ্চ, মহুয়া চত্বর, টারজান চত্বর, ট্রান্সপোর্ট, চৌরঙ্গী, মেহের চত্বর কিংবা হালের মনপুরায় আজ সুখের তরঙ্গ খেলা করছে।
ক্যাম্পাসের প্রতিটি ধুলিকণার বুকেও আজ নিশ্চয় এক অমল স্বর্ণকমল ফুটে উঠেছে। তাদের অবাক চাহনির দিকে ধেয়ে চলছে পাগল হাওয়া। শীতের শিশির ধুয়ে দিচ্ছে শান্তিনিকেতনের গা।
এমন দিনে আবার আবহসংগীত নিয়ে এসেছেন প্রিয় কবিগুরু—
তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে,
এ আগুন ছড়িয়ে গেল সব খানে॥
যত সব মরা গাছের ডালে ডালে
নাচে আগুন তালে তালে রে,
আকাশে হাত তোলে সে কার পানে॥
কে বলেছে আনন্দ-আয়োজন নেই। শোভাযাত্রার হুল্লোড় নেই। আমাদের সবার মনন গাঁথছে মালা পঞ্চাশের জন্মজয়ন্তীর এক সুতোয়। এই মালা কি ছিঁড়তে আছে ক্ষণকালের ঝড়-বাতাসে?
বিদ্যাচর্চা, গবেষণা, নতুন দিকদর্শন, পথের দিশার অনুসন্ধানে আমাদের ক্যাম্পাস হোক বিশ্বসেরা, এটাই সমস্বর প্রার্থনা। ক্যাম্পাসের তীর্থস্থানে তীর্থযাত্রীর মতো শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের হার্দিক মিলনমেলা দীর্ঘজীবী হোক। আমাদের প্রাণের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে আমাদের গর্বের সচল বাহন ভিড়ুক আলোয় উদ্ভাসিত কাঙ্ক্ষিত সুবর্ণবন্দরে।
আরেক পঞ্চাশে সময় ঘুরুক। আকাশময় আশাবাদের ঘুড়িরা উড়ুক। সেই ঘুড়িতে চিরকুট গাঁথা থাক; যেথায় লেখা—প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর, তোমায় ভালোবাসি। শুভ জন্মদিন। তুমি চিরঞ্জীব হও।
বেলা শেষে বিচ্ছেদের তানপুরায় হোক না তবে কারুণ্যের সুরসাধন—
কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো।
বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো।
রয়েছে দীপ না আছে শিখা,
এই কি ভালে ছিল রে লিখা—
ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।
বিরহানলে প্রদীপখানি জ্বালো।
লেখক : সাংবাদিক