পলাশী যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত
স্বার্থান্ধ একাংশ ভারতীয়দের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্রিটিশরা ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে। নিজের চরম অনৈতিক কাজকে আড়াল করতে ব্রিটিশরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সিরাজ সম্পর্কে অনৈতিহাসিক প্রচার চালায়। তাঁর ব্যক্তিচরিত্রকে পর্যন্ত কলঙ্কিত করে। ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী ভাবনার শরিক ঐতিহাসিকেরা বিকৃত তথ্যের ভিত্তিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইতিহাসের পাতায় নির্মাণ করে সিরাজের সামগ্রিক চরিত্রটিকে।
নবাব আলিবর্দীর শাসনকালের শেষ দিকে গোটা বাংলার অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষ, যাঁরা বেশির ভাগই নানারকম যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, একটু বিত্তবান ব্যবসায়ীরা এবং নানা পর্যায়ের জমিদারেরা নবাবের সার্বিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করতে নানা চক্রান্ত ধীরে ধীরে শুরু করেছিল। সিরাজ নবাব হয়েই এই চক্রান্তকারীদের কোমর ভেঙে দিতে সর্বপ্রথম উদ্যোগী হন। ফলে শুরু থেকেই এই কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের সঙ্গে সিরাজের ঠাণ্ডা লড়াই আরম্ভ হয়। শাসনপর্যায়ের সামরিক ও বেসামরিক, দুটি স্তরকেই নবাব হয়ে যেভাবে নতুন করে ঢেলে সাজাতে শুরু করেন সিরাজ, তাতে এই স্বার্থান্বেষী মহল প্রমাদ গুনতে শুরু করে।
খান আবদুল হাদি খান, মোহনলাল, মীরমদন প্রমুখকে নবাব হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন সিরাজ। যে স্বার্থান্বেষী মহলের ক্ষমতা খর্ব করতে সিরাজ এঁদের নিয়োগ করেছিলেন, সেই মহলই ওইসব মানুষের নবাবের মোসাহেব, অপদার্থ ইত্যাদি বলে প্রচার করতেন। এসব প্রচারের সঙ্গে ইতিহাসের এতটুকু সম্পর্ক ছিল না। ব্রিটিশ ঐতিহাসিকেরা এসব প্রচারকেই পরবর্তীতে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলে গেছেন।
মোহনলালকে একটি কলঙ্কিত চরিত্র হিসেবেই ব্রিটিশরা তুলে ধরেছিল। অথচ এই মোহনলাল পলাশীর যুদ্ধে সমস্ত রকমের বিরুদ্ধাচরণকে অস্বীকার করে যেভাবে দেশের হয়ে লড়েছিলেন, সে সম্পর্কে ইতিহাস প্রায় নীরবই থাকে। সিরাজের কলকাতা অভিযানকালেও (১৭৫৬) মোহনলাল যে দক্ষতা এবং অসমসাহসের পরিচয় রেখেছিলেন, সেই ইতিহাসও মানুষের কাছে তুলে ধরা হয় না। পূর্ণিয়া অভিযান এবং পূর্ণিয়ার শাসনব্যবস্থার খোলনলচে বদলাতে মোহনলালের ঐতিহাসিক অবদানের কথা আমরা কজন জানি?
মঁসিয়েঁ জ্যাঁ লঁর অভিমত অনুসারে, মোহনলালকে ইতিহাসে সবার চেয়ে বড় বদমায়েশ বলে বর্ণনা করা আছে। কিন্তু কজন ঐতিহাসিক এই তথ্য তুলে ধরেছেন যে ইংরেজদের চন্দননগর অভিযানে সিরাজের বাধা না দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ল্যঁয়ের মুর্শিদাবাদ থেকে চলে যাওয়ার ঘটনাক্রম? ইংরেজদের চন্দননগর দখলের অভিপ্রায়, সেই কাজে ল্যঁয়ের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা, ক্ষোভ; এসব সম্পর্কে সিরাজকে যথাযথ অবহিত করেছিলেন মোহনলাল।
পলাশীর পরিপ্রেক্ষিত রচনার ক্ষেত্রে চন্দননগরকে ঘিরে ফরাসি এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির টানাপোড়েনে সিরাজকে সঠিক ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে মোহনলাল, মীরমদনদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সঠিক। ফলে জগৎ শেঠদের (মূল নাম ফতেহ চাঁদ) মতো লোকেরা ভালোভাবেই বুঝতে পারছিল যে সিরাজ কোনো অবস্থাতেই তাদের হাতের পুতুল হবেন না। জ্যাঁ কিন্তু জগৎ শেঠের সঙ্গে মোহনলালের সংঘাতের স্বরূপটা বেশ ভালোভাবেই বুঝেছিলেন। সে কারণেই মোহনলালকে তিনি জগৎ শেঠের সবচেয়ে বড় শত্রু বলে বর্ণনা করেছেন। মোহনলালই যে একেবারে কানায়-কানায় টেক্কা দিতে পারেন জগৎ শেঠকে, সে কথাও জ্যাঁ খুব পরিষ্কারভাবে বলে গিয়েছিলেন (Three Frenchmen in Bengal, S C Hill)।
আলিবর্দীর শাসনকালের শেষ দিকে স্বার্থান্বেষী মহল কীভাবে গোটা শাসনতন্ত্রকে নিজেদের হাতের মুঠোয় পুরতে সচেষ্ট হয়ে উঠেছিল, সে সম্পর্কে সিরাজকে সতর্ক করার ক্ষেত্রে খান আবদুল হাদি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেনাবাহিনীকে কেন্দ্র করে মীরজাফর ও খাদিম হুসেন খানের একটা বড় অঙ্কের টাকা পকেটস্থ করার বিষয়টি হাতেনাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন খান আবদুল হাদি। এই প্রসঙ্গগুলো স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর গবেষণাতে খুব পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছেন। খান হাদির এই ভূমিকা যে প্রথম থেকেই সিরাজকে মীরজাফরদের সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিল, স্যার যদুনাথের গবেষণা থেকে তা আমরা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারি। বস্তুত এ ঘটনাবলী জানার ফলে সিরাজের ভেতরে যে অগ্নিবর্ষী একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল হয়ে উঠেছিল, যা কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছিল। তাই তারা সিরাজকে দুর্বিনীত, চরিত্রহীন ইত্যাদি নানা অভিধায় অভিহিত করে পলাশী যুদ্ধের পটভূমিকা নির্মাণের কাজটি বেশ জোরদারভাবেই করতে শুরু করে দিয়েছিল।
পলাশীর আমবাগানে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন , চার ঘণ্টারর যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি না হলেও এই কথাটা খুব জোরের সঙ্গে বলা দরকার যে যুদ্ধে কিন্তু ইংরেজদের অবস্থা আদৌ ভালো ছিল না। জয় আর বরমাল্য যে সিরাজের হাতে প্রায় এসে যাচ্ছিল, সে কথা সমসাময়িক ফরাসি পর্যবেক্ষকদের কথাতে বেশ জোর দিয়েই বলা হয়েছিল (Riaz-us-Salatin by Gulam Husain Salim)। দুপুর তিনটে নাগাদ মীরমদনের আহত হওয়ার ঘটনাই যুদ্ধের চরিত্র বদলে দিল। সিরাজের তাঁবুতে মীরমদনের মৃত্যু যুদ্ধকে এক বিয়োগান্তক পথে ঠেলে দিল। লুক স্ক্রাফটন খুব পরিষ্কারভাবেই লিখেছেন, ভাগ্যক্রমে মীরমদন নিহত হলেন। মীরমদনের মৃত্যুই আমাদের সাফল্যের পথ দাঁড় করিয়ে দিল (Reflections on Government, Luke Scrafton, page-100)।
লেখক : পশ্চিমবঙ্গের গবেষক ও ইতিহাসবিদ