বিজয় দিবসে নতুন আহ্বান
দেশ মানেই নাগরিকের কাছে তীব্র আবেগের উষ্ণ প্রস্রবণ। বিজয় মানেই উৎসবের প্লাবন। বালাদেশের মানুষের জন্য এবারের বিজয় দিবস এক নতুন আনন্দের উপকরণ নিয়ে উপস্থিত। এ যেন বিজয়ের মাসে আরো একটি বড় বিজয়। পদ্মার দুপাড় একত্রিত হলো। আর এই স্বপ্নবুননে চোখ মেলে তাকাল পুরো জাতি, পুরো বিশ্ব। এটিও এক বড় বিজয়, কারণ দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র পরাজিত করে নিজস্ব অর্থায়নেই সম্পূর্ণ হতে চলেছে স্বপ্নের এই সেতু।
লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তপাতের মূল্যে ছিনিয়ে এনেছিলাম আমরা স্বাধীনতা। পৃথিবীর অনেক দেশ পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়েছে। কিন্তু এত রক্ত, এত ত্যাগ খুব কম দেশের জনগণকেই করতে হয়েছে। চব্বিশ বছরের অধীনতা কাটিয়ে আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীনতার স্বাদ। যা ছিল আমাদের গর্বের ও আনন্দের। কিন্তু সেই উপলব্ধি আজ যেন উপভোগ করতে পারছি না। একদিকে উন্নয়নের মহাসড়কে ছুটে চলা, আবার সেই সময়েই মূল্যবোধ, নীতিবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির ঐক্যবোধ যেন এ সমাজ থেকে বিতাড়িত। গণমাধ্যমের খবরে বড় জায়গা নিয়েছে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর হিংসার রাজনীতি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অর্জিত বাংলাদেশ এখন নতুন করে লড়াই করছে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। পদ্মা সেতু তাঁর আমলের সবচেয়ে বড় অর্জন, কিন্তু আরও অসংখ্য অর্জন তাঁর টানা তৃতীয়বারের শাসনামলে হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, সামাজিক খাতের অগ্রগতি দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। তবুও বলতে হয়, অগ্রগতি আসলে থেমে যাওয়ার কোনো বিষয় নয়। এর কোনো অন্ত হয় না। দেশের অগ্রগতি চলবেই। কিন্তু আমরা চাই নাগরিকের অগ্রগতি। আমাদের আরও অগ্রগতি চাই, উন্নয়ন চাই। সেই উন্নয়ন হলো মূল্যবোধ আর চিন্তাধারার অগ্রগতি।
কিন্তু সেখানে যে আমাদের ঘাটতি আছে, তার অনেক প্রমাণ তালিকা করে তুলে ধরা যায়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালেই আমাদের দেখতে হলো, বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকে আমাদের অবস্থান তলানিতে। বিশ্বের ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচে বাংলাদেশ। গত বৃহস্পতিবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ বছরের এই নলেজ ইনডেক্স প্রকাশ করেছে। সূচকটি তৈরিতে শিক্ষার অবস্থা, প্রযুক্তি, উন্নয়ন, উদ্ভাবনসহ সাতটি বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
ঠিক এ জায়গায় এখন নতুন করে নজর দেওয়ার কাজ। বিজয়ের ৪৯তম বার্ষিকী এবার। পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার উৎসব। এই নলেজ ইন্ডেক্সে আমাদের অবস্থান এবং পাশাপাশি উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আস্ফালনের মাঝে বিজয় উদযাপনের আনন্দেই থাকব, না কি শৃঙ্খল মুক্তির আলোকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে অন্ধকারের শক্তিকে পরাভূত করব, তা ভাবার সময় এসেছে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নানা গলদের কথা আমরা জানি।আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কয়েক ভাগে বিভক্ত। ইংরেজি মাধ্যম আর বাংলা মাধ্যমেও নানা বিভাজন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থাতেই সন্তানেরা কতটুকু মানুষ হলো, সে ভাবনা নেই। অভিভাবকদের ভাবনায় কেবল সন্তানদের সফল করে গড়ে তোলা, যতটা না মানুষ বানানোর প্রচেষ্টা।
আমরা সবাই বলছি সমাজে মূল্যবোধের বড় অবক্ষয় চলছে। আমরা এটাও দেখছি বর্তমানে তথাকথিত আধুনিকতার প্রভাবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে কোনোরকম স্থান-কাল-পাত্রভেদ থাকছে না। তা সে শহরই হোক বা গ্রামেরই হোক। কিশোর গ্যাং কালচার বা পাড়ায়-পাড়ায় সহিংসতা ও সন্ত্রাস বাড়ছে। দিনের পর দিন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নৈতিক মানের অবনমন ঘটে চলেছে। এ সমস্যা এক গভীরতর সামাজিক সমস্যায় পরিণত হচ্ছে। সব পড়ুয়াই যে এই অবনমনের শিকার, তা মোটেও নয়। কিন্তু বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী এর শিকার তো অবশ্যই। যা একই সঙ্গে তাদের নিজেদের শিক্ষা এবং বন্ধুবান্ধবের শিক্ষাকেও ব্যাহত করছে।
এই বাস্তবতায় সমাজে বাড়ছে বৈষম্য, বাড়ছে কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতা। ১৯৭১-এ আমরা চেয়েছিলাম পাকিস্তানি অপশাসন থেকে মুক্তি। আমাদের এখনকার প্রচেষ্টা অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কিন্তু আজ একইসঙ্গে আমরা অনুভব করছি, অন্য অনেক কিছু থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রয়োজন আমাদের। অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের নামে হিংসা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, সম্পদ ও অর্থ পাচার এবং সর্বগ্রাসী দুর্নীতি—এ রকম অসংখ্য সামাজিক বিষ আজ আমাদের গিলে খেতে চাইছে।
তাই এবারের বিজয় দিবস আমাদের জন্য এক নতুন পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে উপস্থিত। সহিংসতা, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি, নারী নির্যাতনসহ সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক দেওয়া প্রয়োজন এবার। তবেই আমরা সত্যিকারের অগ্রগতির পথ দেখব। দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে নৈতিক মানের অবক্ষয় প্রতিরোধ করতে, সাম্প্রদায়িকতাকে রুখতে। এবার বিজয় দিবস পালিত হোক দেশকে পিছিয়ে দেওয়ার সামাজিক বিষ থেকে মুক্তি পাওয়ার শপথে।
লেখক : সাংবাদিক