বিশের বিষাদ শেষে একুশে
প্রতিটি বছর শেষ হয় কিছু প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি নিয়ে। কিন্তু ২০২০ সালের হিসাব আমাদের জন্য বড়ই কঠিন। অন্য বছরে বিদায় জানাতে কষ্ট হতো। কিন্তু এবার যেন মানুষের মন চেয়েছে কখন শেষ হবে বছরটা। কারণ, এ বছর আমাদের ঘরে চুপিসারে হানা দিয়েছিল করোনাভাইরাস। তারপর পুরো বছর দাপিয়ে বেড়িয়েছে। চেনা পৃথিবীটাকে বদলে দিয়েছে করোনা।
কাজ বন্ধ, রোজগার বন্ধ, কর্মহীন লাখ লাখ মানুষ, নিকট আর দূর থেকে আসছে মৃত্যু আর আক্রান্তের খবর। হঠাৎ করে সব বদলে গেল। হঠাৎ করে আমাদের কর্মচঞ্চল পরিবেশটায় অভাবী মানুষের মুখ। হাসপাতালে চিকিৎসা সংকট, স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশা। মানুষের মৃত্যুর মিছিল। স্বজন হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল আমাদের মন। করোনার থাবায় মানুষ যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তখনই আছড়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। দীর্ঘ সময় বেশ কিছু জেলায় বন্যা। সব মিলিয়ে বিশ সালটা আমাদের কাছে বিষ হিসেবেই চিহ্নিত হলো।
বছর ফুরিয়েছে। অনেক কিছু হারিয়েছি আমরা। কিন্তু শিখেছি অনেক। গণমাধ্যমের কথাই যদি ধরি, তাহলে বলব, আমরা বড় কঠিন অবস্থার ভেতর দিয়ে গিয়েছি। কিন্তু বছরটি আমাদের শিখিয়েছে অনেক। করোনার বিরুদ্ধে এই অসম যুদ্ধে সামনে থেকে মানুষকে নিরলস তথ্যসেবা দিয়ে সচেতন করে গেছে প্রতিটি গণমাধ্যম এবং তাদের কর্মীরা।
করোনার মতো এই ভয়াবহ রোগটি হঠাৎ করেই এসেছিল। মানুষের তৈরি ছিল না একেবারে। সাংবাদিকদেরও নয়। কিন্তু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং এর কর্মীরা দ্রুতই পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে মানুষকে তথ্য দিয়ে গেছে, রোগ সম্পর্কে সচেতন করেছে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদের ডেকে এনে মানুষকে প্রতিরোধব্যবস্থা শিখিয়েছে।
বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। একদম শুরুতে সংবাদমাধ্যমগুলো শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে তৎপর হয়। অফিসে এবং কর্মী আনা-নেওয়ার পরিবহণগুলো জীবাণুনাশক ছিটিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করে। একদম জরুরি কর্মী ছাড়া বড় অংশই বাসায় থেকে কাজ করার প্রক্রিয়া শুরু করে। সবাই হয়তো এমনটা করতে পারেনি। কিন্তু চেষ্টা ছিল। সবচেয়ে বড় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে ঢাকার বাইরের সাংবাদিকেরা।
আসলে কোভিড-১৯ এমন এক সময়ে আঘাত করেছে, যখন বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অবস্থা এমনিতেই বেশ সঙ্গীন ছিল। এমনিতেই ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিচালিত হয় এক বৈরী পরিবেশে। সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভাজিত সাংবাদিক সমাজের নানা সমীকরণ, সমালোচনা সইতে না পারার সংস্কৃতি ছাড়াও বাংলাদেশের গণমাধ্যম সনাতনভাবেই কাজ করে এক ধরনের আর্থিক অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে।
করোনা আসার আগে থেকেই মিডিয়ার রাজস্ব আয় কমছিল। সেটি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে করোনার অভিঘাতে। ডিজিটাল দুনিয়ায় সামাজিক মাধ্যমের আগ্রাসী অবস্থান এবং হাতে হাতে স্মার্টফোনের ব্যাপক বিস্তারে প্রচলিত গণমাধ্যমের ব্যবসা সংকুচিত হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। করোনা এসে এতে আরও গতি জুগিয়েছে। পাঠক আর দর্শক কমে যাওয়ায় বিজ্ঞাপন হ্রাসে গণমাধ্যমের স্বাভাবিক পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর বাইরে বেড়েছে কাজের চাপ, তৈরি হয়েছে আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।
শত শত সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, অনেকে মারাও গেছেন। করোনার নমুনা পরীক্ষার সেভাবে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ছিল না। তবে উদ্যমী সম্প্রচার সাংবাদিকদের সংগঠন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেস ক্লাব তাদের সদস্যদের জন্য নমুনা পরীক্ষার আয়োজন করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায়।
পত্রিকাগুলো পৃষ্ঠাসংখ্যা কমিয়েছে, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো (দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া) জুমের মাধ্যমে টকশো আয়োজন করে ও বড় সময় ধরে একই ঘটনা লাইভ করে খরচ কমানোর চেষ্টা করে চলেছে। অনুষ্ঠানভিত্তিক চ্যানেলগুলো নতুন নাটক ও অনুষ্ঠান কেনা বন্ধ রেখেছে। কোনো কোনো হাউস কর্মী ছাঁটাই করেছে, কেউ বা অনেক কর্মীকে বাধ্যতামূলক বিনা বেতনে ছুটিতে পাঠিয়েছে। তার পরও এ সময়টিতে মিডিয়ায় সরকারের প্রচার বেড়েছে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
তাই বলতে হয়, করোনায় সব বিষাদের মাঝেও আলোর রেখা দেখেছি মিডিয়া ভুবনে। প্রায় সব বড় মাধ্যমই অনলাইনে তাদের বিচরণ বাড়িয়েছে এবং অনেকে সাফল্যও পেয়েছে। প্রিন্টে আর পর্দায় রাজস্ব কমলেও অনেকে আয়ের পথ দেখছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। কারণ, মানুষ এখন পত্রিকা পড়া ও টেলিভিশন দেখার চেয়ে বেশি ব্যস্ত ডিজিটাল জগতে।
তাই কোভিড-১৯ গণমাধ্যমের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ—দুটি পথই খুলে দিয়েছে। এখন প্রিন্ট আর ইলেকট্রনিক মিডিয়া আলাদা করা যাচ্ছে না, প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতিযোগী। প্রত্যেকেই এক ধরনের গ্রাহক আর বিজ্ঞাপন ধরতে সক্রিয়। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার—এই বাজারটা বড়, কিন্তু মিডিয়া নিজে ততটা বড় কি না, সেটাই ভাবনার বিষয়। কী করে মানসম্পন্ন কনটেন্ট নিয়ে মানুষের কাছে উপস্থিত হওয়া যাবে, সেটিই বড় কৌশল।
নতুন বছর, নতুন আশা এবং নতুন চ্যালেঞ্জ। বছরটি ছেড়ে এসেছি। কিন্তু ভুলে যেতে চাই না পশ্চাতের কথা। আমাদের অসংখ্য কর্মী কর্তব্যে অবিচল থেকে জীবনের জয়গান গেয়েছেন, বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমি বলব বছরটি তাঁদেরই। বছর শেষ হলেও মহামারির যাতনা থেকে নিষ্কৃতি মেলেনি। ভ্যাকসিন এসেছে। সেটি কবে আসবে দেশে, তার প্রয়োগ, বিতরণ কতটা ন্যায্যভাবে হবে—গণমাধ্যমের নজর থাকবে সেখানেও।
লেখক : সাংবাদিক