মেধা ও মননে দুর্বল করতেই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রধান টার্গেট। ২৫ মার্চের কালরাত ও যুদ্ধের নয় মাসে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় বুদ্ধিজীবীদের। কারণ, তাঁদের মেধা ও মননে অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিক মূল্যবোধ ছিল গভীরভাবে প্রোথিত। এই বোধ তাঁরা ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তরে। তাঁদের মননে ছিল শোষণমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় যখন দরজায় কড়া নাড়ছে, তার ঠিক দুদিন আগে এক নজিরবহীন ঘটনার সাক্ষী হয় বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর, বাঙালি জাগরণের সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে পাকিস্তান ভয়ঙ্কর নীলনকশা বাস্তবায়ন করে। এই নির্মমতার রূপকার ছিল একদিকে যেমন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, অন্যদিকে তাদের এ দেশীয় সহচর আলবদর, রাজাকার ও আলশামস বাহিনীর নেতারা; যারা পরিকল্পিত পন্থায় বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিল্পী, কবি, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিককে রাতের অন্ধকারে চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁদের ওপর নির্মম ও নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়ে নারকীয়ভাবে হত্যা করা হয়। দেশব্যাপী পরিচালিত নয় মাসের গণহত্যায় অগণিত মানুষের প্রাণদানের সীমাহীন ট্র্যাজেডিতে ভয়াবহ মাত্রা যোগ করেছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ যেন মেধা-মননে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সে কারণেই মূলত এই বর্বর হত্যাকাণ্ড। তবে বাঙালি জাতিকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল ও পঙ্গু করে দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন তারা শুরু করে যুদ্ধের একদম শুরু থেকেই।
ঢাকায় এই হত্যার ব্যাপকতা বেশি হলেও দেশের জেলা সদরেও চলে একই নিষ্ঠুরতা। হত্যা মিশনে নিযুক্ত অস্ত্রধারীরা গেস্টাপো কায়দায় তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে তুলে আনে, তাঁদের চোখ বেঁধে দেয়, তারপর ঢাকার মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, মিরপুর, রাজারবাগের বিভিন্ন টর্চার সেলে নিয়ে যায়। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, গুলি করে এসব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয় এবং রায়েরবাজার, মিরপুরের আলোকদি, কালাপানি, রাইনখোলা ইত্যাদি জায়গায় লাশ ফেলে রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে বিভিন্ন দলিলপত্র দেখে জানা গেছে, এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কর্নেল হেজাজি, মেজর জহুর, মেজর আসলাম, ক্যাপ্টেন নাসির ও ক্যাপ্টেন কাউয়ুমসহ প্রায় ১০ জন সামরিক ও বেসামরিক অফিসার। আর বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রস্তুত ও হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নেপথ্য কারিগর ছিল জামায়াতে ইসলামী।
২৫ মার্চের রাত থেকেই শুরু হয় মূলত বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ এবং ১৪ ডিসেম্বর সেটার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পায়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাপিডিয়ার সূত্রমতে, এঁদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য ২ জন। তবে ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন ও পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিন এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এক হাজার ৭০ জন। ১৯৭১ সালের ২৯ ডিসেম্বরে গঠিত শহীদ বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তান আর্মি ও জেনারেল রাও ফরমান আলী এ দেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এ পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়নি। ফরমান আলীর টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের গভর্নর হাউসে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে হত্যা করা।
অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে ২৫ মার্চ যে গণহত্যার সূচনা করে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী, তা মূলত শুরুই হয় বুদ্ধিবৃত্তিক, সৃজনশীল মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে। ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পূর্বে যে বীভৎস নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল, তা পৃথিবীর ইতিহাসে কখনোই ঘটেনি। ১৪ ডিসেম্বর বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ স্তম্ভিত হয়েছিল, গোটা বিশ্ব অবাক হয়ে প্রত্যক্ষ করেছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের বর্বরতা। বুদ্ধিজীবীদের আলাদাভাবে টার্গেট করার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ ছিল। দেশভাগের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশে যে কয়টি আন্দোলন হয়েছে তার প্রায় সবকটির শুরুটা ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন দিয়ে, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কারণ উদঘাটন করতে হলে পাকিস্তান আমলের সেই পঁচিশ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অনুধাবন করতে হবে। ১৯৪৭ থেকে ’৭১- এ সময়ের মধ্যে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। জমিদারি প্রথার অবসান ঘটার ফলে ধীরে ধীরে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটেছে। সেইসঙ্গে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণিরও জন্ম হতে থাকে। তাদের মন-মানসিকতায় পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। সমাজের ভেতর এই মৌলিক পরিবর্তনের ধারা আমাদের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। তাঁরা প্রতিটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেই আলোকবর্তিকা হয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর সে কারণেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে নিশ্চিত হার বুঝতে পেরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে ১৪ ডিসেম্বরের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটায়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়