শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস স্মরণে
আজ ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দিন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ও সমাপ্তিলগ্নে পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন অনেক দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার সাথে একসাথেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
দীর্ঘ ৯ মাসের সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় চলে আসার প্রাক্কালে নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে জাতিকে মেধাশূন্য করতে নিষ্ঠুর পরিকল্পনা সাজায় হানাদার বাহিনী। ডিসেম্বরের ৪ তারিখ হতে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ হতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেওয়া হতে থাকে। তারা স্বাধীনতা বিরোধীদের সহযোগিতায় একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বহু গুণীজনকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঠিক দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বাধীন বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। প্রতিবছর গভীর শোক ও শ্রদ্ধার সঙ্গে দিনটি পালন করা হয়।
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ১৬জন শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন,পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা গেছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গঠিত বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০,০০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন।
কিন্তু এই পরিকল্পনা মতো হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়নি। কারণ ফরমান আলীর টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদেরকে গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে মেরে ফেলা।
স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে তৎকালীন সরকার। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বিষয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর মতান্তরে ২৯ ডিসেম্বর বেসরকারিভাবে গঠিত হয় ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন’। এরপর গঠিত হয় ‘বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি’। কিন্ত তাঁর এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিশনের আহবায়ক ছিলেন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান যিনি নিখোঁজ হন ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। জহির রায়হান বলেছিলেন, এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে আঘাত হেনেছে।
জাতির এই মহান বীর সন্তানদের শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করতে গিয়ে মনে নানা ভাবনার উদয় হয়। যাঁরা নিজেদের জ্ঞান-মনীষা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন, আলোকিত করেছেন, তাঁদের বছরের একটি দিন স্মরণ করাই যথেষ্ট নয়।
আমাদের অনুধাবন করতে হবে কেন এই মহৎপ্রাণ মানুষগুলো জীবন দিয়েছেন। তাঁদের চিন্তা ও আদর্শ কী ছিল। মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, তাঁরা চোখে যে স্বপ্নটা নিয়ে গেছেন, তা ছিল সাম্য-মর্যাদা-সুবিচারের, এক আদর্শিক সোনার বাংলার। সেই স্বপ্নটা ফিরিয়ে আনতে, তার বীজগুলো নতুন করে বুনতে একাত্তরকে তুলে দিতে হবে তরুণদের হাতে। শিক্ষার্থীদের মাঝে সঠিক ইতিহাস চেতনা সৃষ্টি করতে চাই দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা-নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সক্রিয় আন্তরিকতা। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা সরকারিভাবে আজও প্রণয়ন করা হয়নি। সেই তালিকা তৈরির পাশাপাশি তাঁদের স্মরণে বছরব্যাপী নিয়মিতভাবে নানাবিধ আয়োজনসহ জাতীয়ভাবে বিভিন্ন স্থাপনা, স্মৃতি স্মারক স্থাপন করার দাবি জানাই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার আমাদের আশাবাদী করে তোলে। জাতীয় স্বার্থেই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত কমিশন গঠন ও বিচার পরিচালনার জোর দাবি জানাই। একাত্তরের ঘাতক-দালাল-রাজাকার-আল বদরদের বিচারের মতো বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলাদা বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হোক। বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে আজ যে দিবস পালিত হচ্ছে তা সার্থক হবে, যদি আমরা একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক বুনিয়াদ আরও শক্তিশালী করার কাজে ব্রতী হই। তাঁরা যে উন্নত চিন্তা ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই পথ ধরেই বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে, এই হোক শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অঙ্গীকার।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা।