সমরেশ চলে গেলেও রয়ে যায় রেশ
‘‘মৃত্যু কী সহজ, কী নিঃশব্দে আসে, অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়’—সমরেশ মজুমদারের এই উক্তটি এখন বাংলা ভাষাভাষি পাঠকের মুখ থেকে মুখে স্খান পরিবর্তন করে চলেছে প্রতিনিয়ত। পারতপক্ষে সমরেশ কখনও জীবন নিয়ে গর্ভবোধ করেননি। তিনি স্থির মনবৃত্তি নিয়ে লিখে গেছেন এক জীবন। তাঁর এক জীবনের লেখা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে আর জীবনের মতো। ১৯৬৭ সালে দেশ পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয় তাঁর লেখা গল্প ‘অন্যমাত্রা’। বিনিময়ে পেয়েছিল পনেরো টাকা। এরপর ১৯৭৬ সালে ‘দেশ পত্রিকা’য় প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ প্রকাশিত হবার পর ক্রমাগত লিখেই গেছেন তিনি। লেখার জন্যই যেন তাঁর জন্ম। অতঃপর তাঁর লেখার দৌড় এসে থামল ২০২৩ সালের মে মাসের ৮ তারিখ সন্ধ্যায়।
বরেণ্য এই কথাসাহিত্যিকের সাথে আমার পরিচয় হয় কৈশোরে। পরিচয়ের সূত্রপাত অবশ্য ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে, তার লেখা ‘শাপ মোচন’ উপন্যাস পড়তে গিয়ে আমি প্রেমে পড়ি প্রেমের। আমি প্রেমে পড়ি সাহিত্যের, প্রেমে পড়ি উপন্যাসের। আমার কাছে মনে হতে থাকে—এ এক আলদা জগৎ, যেখানে আর্থিক স্বচ্ছলতা-অস্বচ্ছলতা নেই, প্রতিক্রিয়াশীলতা নেই, লাভ-ক্ষতির দর কষাকষি নেই, প্রতিযোগিতা নেই, সংকীর্ণতা নেই, প্রতিষ্ঠা-অপ্রতিষ্ঠার ভাবনা নেই; আছে কেবল মননশীলতার তৃপ্তি। এই তৃপ্তির ঢেকুর প্রমথ চৌধুরী তুলেছিলেন বলেই হয়তো লিখেছিলেন এক প্রবন্ধ—‘সাহিত্যে খেলা’।
কৈশোর বয়সে ‘শাপ মোচন’ আমাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছিল ঠিক, কিন্তু সেই প্রেম পরবর্তীকালে আমাকে নিয়ে যায় সমরেশের জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সের চা বাগানে। যেখানে ১৯৪২ সালের ১০ মার্চ সুদর্শন মিতভাষী দীর্ঘকায় এক সুঠাম দেহের অধিকারী পৌরুষের জন্ম হয়। নাম তাঁর সমরেশ মজুমদার। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলের ছাত্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে করেছেন স্নতোকোত্তর। একেএকে পড়ে ফেলি তাঁর লেখা উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ ত্রিরত্ন ত্রয়ী উপন্যাস। পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করি—একটা মানুষের মগজপ্রদেশে কয় সমুদ্র বাক্যসম্ভার থাকলে এমন শব্দবহুল উপন্যাস লেখা সহজ! যেন তাঁর কলমের উত্তাপে খইয়ের মতো ফুটতে থাকে শব্দ। মানুষকে পড়তে পারার ক্ষমতাও রপ্ত করেছিল বিস্ময়করভাবে, তিনি যা লিখতেন, তা উপলদ্ধি করে লিখতেন। উপলদ্ধির অতলস্পর্শী গভীরতা থেকে তিনি তাঁর লেখায় বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর যদি মানুষকে অন্তত একদিনের জন্যে অন্যের মনের কথা পড়ার ক্ষমতা দিতেন, তাহলে নব্বই ভাগ মানুষ কেউ কারো সঙ্গে থাকতে পারত না।’
বাস্তবিক অর্থেই তাই, যাই হোক তাঁর লিখিত বিখ্যাত ট্রিলোজি সিরিজের মধ্যে প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরাধিকার’, সিরিজটি শেষ হয় ‘কালপুরুষ’ দিয়ে। মাঝের উপন্যাস ‘কালবেলা’, যা ধারাবাহিকভাবে ‘দেশ পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয় ১৯৮১-১৯৮২ সালের দিকে। ১৯৮৪ সালে এই বই তাকে এনে দেয় সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার।
আমি আন্দোলিত হই, যখন দেখি আশির দশকে বাঙালি সমাজ ব্যবস্থায় সমরেশ মজুমদার অনিমেষ ও মাধবীলতার মাধ্যমে দেখিয়েছেন—যদি ভালোবাসা থাকে, তবে বিয়ের মতো এক সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা তথা চুক্তির মধ্যে না গিয়েও পাশাপাশি বসবাস করা যায়। বিয়ের অনুপুস্থিতিতে স্বামী ও স্ত্রীর ন্যায় মনুষ্য জীবন পার করে দেওয়া যায় ভালোবাসা এবং বিশ্বাসের উপস্থিতিতে। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি স্বয়ং ঢাকায় আয়োজিত এক লেখক গল্প আড্ডায় স্বীকার করেছিলেন, ‘লেখার সময় মনে হতো—তৎকালীন রক্ষণশীল বাঙালি সমাজ অনিমেষ এবং মাধবীলতাকে মেনে নেবে না। ভেবেছিলাম—আমাকে খিস্তি দিয়ে আমার বই বাজেয়াপ্তের হাঁক তুলবে, কিন্তু না, মানুষ গ্রহণ করেছে।’
সেইসঙ্গে উপন্যাস ঘিরে আবর্তিত নকশালবাড়ির আন্দোলন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক তো ছিলই। এমন এক রাজনৈতিক তালমাতালের প্রেক্ষাপটে ‘কালবেলা’ উপন্যাস রচনা করেছেন, যখন ভরা বামফ্রন্ট এবং সিপিএমের ভাবমূর্তি চতুর্দিকে ঘোলাটে অবস্থা। লেখকে নজরদারিতে রাখা হতো, যেকোনো সময় আসতে পারে জীবনের প্রতি হুমকি। তথাপি, তিনি রাজনৈতিক ঈর্ষা ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লিখেছেন, তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে। গর্ভধারিণী উপন্যাসে তাই লিখেছেন, ‘অভাব থেকেই তো অক্ষমতা, ঈর্ষা আসে। আর সেটাকে ঢাকতে বেশির ভাগ মানুষই গলা চড়িয়ে মেজাজ দেখানো ছাড়া অন্য কোন পথ পায় না।’
বস্তুত দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের অনুপ্রেরণায় সমরেশ মজুমদার কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠেন। জীবনের শুরুতে তিনি থিয়েটারে যোগ দেন, সেখানে নাটক লিখতে গিয়ে লিখে ফেলেন গল্প। গল্পের সূত্র ধরেই একদিন সাগরময় ঘোষ ডেকে বললেন, এবার তুমি একটা ধারাবাহিক উপন্যাস লেখো বরং। প্রথমে একটু ইতস্তত করেছিলেন, কিন্তু লিখলেন। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি, একেএকে সৃষ্টি করেছেন—দৌড়, সাতকাহন, তেরো পার্বণ, গর্ভধারিণী, স্বপ্নের বাজার, উজান গঙ্গা, মৌষলকাল, মনের মতো মন, ভিক্টোরিয়ার বাগান, অনুরাগসহ অর্ধশতের অধিক উপন্যাস। তাঁর লেখা এ বিপুল সংখ্যক উপন্যাসের সাথে প্রাসঙ্গিক একটি উক্তি পাওয়া যায় তাঁরই মৌষলকাল উপন্যাসে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘বিখ্যাত লেখকরা বোধ হয় এভাবেই উপন্যাসে লিখে থাকেন, যা পাঠক আগে আন্দাজ করতে পারে না।’
ঢাকায় অনুষ্ঠিত সেই লেখক গল্প আড্ডায় আমার থাকার সুযোগ হয়েছিল বাংলাদেশের এক তরুণ লেখক হিসেবে। তরুণ লেখক বলতে যা বোঝায়, আমি তখন তার চেয়েও বেশি তরুণ, স্নাতকের পাঠ তখনও চুকোয়নি। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করি, উপসম্পাদকীয় লিখি। মলাট আকারে উপন্যাস বের হতে শুরু করেছে সবেমাত্র। তরুণ লেখক শুনে তিনি বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে জানতে চাইলেন, লেখ কেন?’
আমি সহসা স্মিত হেসে প্রসন্ন দৃষ্টিতে উত্তর দিলাম, ‘লিখতে না পারলে অস্বস্তি হয়, তাই লিখি।’ তিনি বেশ বাহবা দিলেন। খুশিও হলেন বোঝা গেল। প্রকাশ করলেন বাংলাদেশের তরুণ লেখকদের নিয়ে সম্ভাবনার কথা।
বাংলাদেশ নিয়ে এই মানুষটির আলাদা কৌতুহল ছিল, ছিল এখানকার কবি ও কথাসাহিত্যিকদের সাথে দারুণ সখ্যতা। যাদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ অন্যতম। বাংলাদেশে এলে লেখক হুমায়ূনের কাছে থাকতেন, হুমায়ূনকে কলকাতার মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলতে তাঁর এক প্রকার তাড়না ছিল, এ কথা সর্বজন বিধৃত। এ ছাড়া শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ শামসুল হকসহ অনেকের লেখা তিনি পছন্দ করতেন, পড়তেন। অধিকন্তু বাংলাদেশের ঘটনাবহুল পটভূমি নিয়ে লিখতে চেয়েছিলেন বই। এ বইয়ে মূলত পরাধীন ব্রিটিশ ভারতের ৪৬-এর দাঙ্গা থেকে শুরু করে ৪৭-এর দেশভাগ, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুথান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৭৫-এর সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ স্বাধীন বাংলাদেশের ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন। কবিতার প্রতি তাঁর ছিল তীব্র ঝোঁক। তবে, সকলের যে কবি হতে হবে, তা তিনি মানতে পারতেন না। তিনি অপছন্দ করতেন সকলের কবি হওয়ার প্রবণতা। এ প্রসঙ্গে কবি মোহাম্মদ রফিকের লেখা ‘খোলা কবিতা’র পঙক্তি মনে পড়ে যায়, ‘সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই।’
বেশ কিছু কবিতা সমরেশ মজুমদার লিখলেও প্রকাশ্যে আনতে সর্বত্রই তাঁর মধ্যে অনীহা দেখা যেত। তাঁর লিখিত কবিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি, ‘এই যে আমি তোমাকে দেখছি,/দেখে মন ভরে যাচ্ছে,/না দেখতে পেলে বুক টনটন করে,/বেঁচে থাকাটা বিবর্ণ হয়ে যায়,/এই অনুভূতি কি/ভালোবাসা নয়?’
তবে সমরেশ মজুমদার উপন্যাসিক হিসাবে সমাদৃত হয়েছেন। এই বিবেচনায় জীবনানন্দ দাশের সাথে সাদৃশ্য পাওয়া যায় কিছুটা। জীবনানন্দ দাশ কবিতার পাশাপাশি উপন্যাসও লিখেছেন, যেমন—কল্যাণী, সতীর্থ, মাল্যদান ইত্যাদি। কিন্তু, জীবনভর তিনি নির্জনতার কবি হিসেবেই সমাদৃত হয়েছেন। সমরেশও একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, জীবনানন্দের কবিতায় তিনি উদ্বেলিত হন।
ঢাকায় সমরেশ বিগত এক দশকে যতবার এসেছেন তার অধিকাংশই হয়তো বাতিঘরের আমন্ত্রণে। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশের প্রতি, বাঙলা ভাষার প্রতি এবং বাঙালির প্রতি এক প্রগাঢ় টান থেকেই তিনি বাংলাদেশে বারবার ছুটে এসেছেন।
ব্যক্তি হিসেবে আমি সমরেশ মজুমদারকে দেখেছি নির্মীলিত মানুষ হিসেবে—বেশ গম্ভীর প্রকৃতির, হিসেব করে কথা খরচ করতেন, তবে আন্তরিক। হাসতেন খুব ছোট করে, দূর থেকে দেখলে যা বোঝা যায় না। কলকাতা ফিরে যাওয়ার আগে দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর লেখা ছোট্ট একটি বই—‘অপরিচিত জীবনযাপন’। বইটিতে দেওয়া তাঁর অটোগ্রাফ আজও স্বচ্ছ জলের মতো টলমল।
প্রখ্যাত এই কথাসাহিত্যিকের সঙ্গে সরাসরি আলাপ হওয়ার আগেও রয়েছে আরও একটি স্মৃতি আছে আমার, যদিও তিনি তা জানেন না। আমার একটা নেশা রয়েছে। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি মানুষ কোনো না কোনো নেশায় আবদ্ধ। আমি এর ব্যতিক্রম নই, আমার নেশা বইয়ের নেশা। একবার হলো কী, নীলক্ষেত গিয়েছি বই কিনতে গেছি। আমি তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেছি। ক্যাম্পাসও ঠিক মতো পরিচিত হয়ে উঠেনি। একাডেমিক এবং নন-একাডেমিক বই মিলিয়ে প্রায় হাজার খানেক টাকার বই কিনলাম। দোকানিকে টাকা পরিশোধ করার পর খেয়াল করলাম—বইয়ের মূল্য মিটিয়ে অবশিষ্ট কোনো টাকা নেই, যা দিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরব। এখন কী করি, আমার এই নাজেহাল অবস্থা অনুমান করে বইসমূয়ের মধ্যে একটা বই যার মূল্য তুলনামূলক কম, দোকানি তা রেখে দিতে চাইলেন, যাতে আমার হাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছানোর খরচটা থাকে। আমি লক্ষ্য করলাম, বইটি সমরেশ মজুদদারের লেখা ‘আট কুঠরো নয় দরজা’। তাৎক্ষণাৎ আমার চোখ স্থির হয়ে রইল। আমি সেটি করতে দিলাম না। বইটি নিয়ে খালি পকেটেই নীলক্ষেত থেকে সাইন্সল্যাব হেঁটে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের জন্য দাঁড়িয়ে রইলাম। বাসের জন্য পেরিয়ে গেল ঘণ্টা খানেক।
সেদিন বই কিনে দেউলিয়া হয়ে শূন্য পকেটে ফিরেছি ক্যাম্পাসে, তবু রেখে আসিনি সমরেশকে। সমরেশের রেশ যাকে একবার ছোঁয়, তাকে উপেক্ষা করার সাহস কারও পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। আপনার আট দশকের এই দীর্ঘ জার্নির প্রতি শ্রদ্ধা সমরেশ মজুমদার। প্রণতি সমরেশ বাবু।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট