সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিশ্চিত হোক
আজ শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাতে গিয়ে আমাদের তরুণেরা ঢাকার রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। আজ আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করছি ভাষাশহীদ সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ সকল ভাষাশহীদ ও ভাষাসৈনিকসহ সবাইকে।
শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এলে আমরা মাতৃভাষা বাংলার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাই। কিন্তু আমাদের সারা বছরের কাজকর্মে সেই আবেগের প্রকাশ কতটুকু থাকে, সেটি আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের গৌরবের প্রকাশ ঘটতে পারে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে মাতৃভাষার যথাযথ প্রয়োগ ও প্রচলনের মাধ্যমে। কিন্তু বাস্তবে আদৌ তা ঘটছে না। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, শিক্ষাক্ষেত্র, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা অবহেলার শিকার। সামাজিকভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান-আপ্যায়নের নিমন্ত্রণপত্র থেকে শুরু করে দোকানপাটের পণ্য বিক্রির তালিকা কিংবা অর্থ লেনদেনের রসিদে পর্যন্ত বাংলা ভাষার ব্যবহার যথাযথভাবে এখনও প্রতিষ্ঠা পায়নি।
অথচ শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আসলে যেভাবে চেতনাকে সামনে তুলে ধরতে চাই, সেভাবে সারা বছর এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে তা মোটেও ধারেকাছে যাই না।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদে লেখা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। সাংবিধানিকভাবে থাকলেও সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়ায় ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭’ প্রণয়ন করা হয়। ওই আইনের ৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিত হইবে। এই ধারা মোতাবেক কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’
এই আইন প্রণয়নের পর তা কার্যকর করার জন্য কয়েক দফা তা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে যে ভাষার জন্য বাঙালিদের রক্ত দিতে হয়েছে, যে ভাষার লড়াইয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ তা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে, সেই বাঙালিদের লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত ভাষা ব্যবহার এবং চর্চার জন্য আইন ও বিচারের প্রয়োগ ঘটাতে হচ্ছে, এমন বিষয় ভাবতেই আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে আমরা মোটেও লজ্জিত হচ্ছি না।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারার মাধ্যমেই ত্বরান্বিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথ। তাই তো স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন সর্বজনীন বাংলা ভাষার চর্চা নিশ্চিত করতে। তিনি জানতেন, বুঝতেন আমাদের স্বাধীনতার পেছনে রাষ্ট্রভাষার অবদান কতটুকু ছিল। তিনি নিজেও ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একজন অগ্রসৈনিক। তিনি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রথম ভাষণ বাংলায়ই দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর ভারতেও জাতির পিতার সফরকালে সবাই বাংলায়ই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনতে চেয়েছিল। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা পায় বাংলা।
মানুষের মনের ভাব, আনন্দ-বেদনা, ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা সবকিছু স্বদেশি ভাষা তথা মাতৃভাষাতেই যথার্থভাবে প্রকাশ হয়। একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে সর্বস্তরে সে জাতির মাতৃভাষার প্রচলন অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে পণ্য, সেবা, ভবন, প্রতিষ্ঠান বা অন্য যে কোনও কিছুর নামকরণে বাংলা শব্দের প্রয়োগের প্রবণতা দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এর পেছনের কারণ হলো চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজিতে যারা দক্ষ তাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। অথচ জাপানসহ পৃথিবীর বহু দেশ নিজেদের ভাষাকে সব সময়ই প্রাধান্য দিয়ে তাদের স্বকীয়তা ধরে রেখেছে।
আমরা যদি বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরের প্রয়োগ করতে না পারি, তাহলে আমাদের একুশের চেতনার কোনও মূল্য নেই। একুশের চেতনা যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে বাংলাকে সর্বস্তরের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই সকলের মানসিকতা বদলে নিতে হবে। ব্রিটিশরা আমাদের মনে পরনির্ভরতা ও বিদেশি ভাষার প্রতি যে অনুরাগ তৈরি করে গেছে, সেটি বদলাতে হবে। বিদেশি শব্দ ও ভাবধারার প্রতি আমাদের দুর্বলতা দূর করতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ সরকারিভাবে তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহারে সাফল্য দেখাতে পারলে আমরা কেন পারব না। এর জন্য কেবল দরকার সরকারের সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ, তদারকি ও এর যথাযথ প্রয়োগ। পাশাপাশি মাতৃভাষার প্রতি সাধারণ মানুষের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়