সাংবাদিক ফাগুন রেজা হত্যার এক বছর : পিতা হিসেবে বলছি, বিচার পাব কি?
চারদিকে দুর্যোগ। করোনা তো রয়েছেই, সঙ্গে সাইক্লোন আম্পান। এর মধ্যে আমার ফাগুনের, সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্ণ হলো আজ। ২১ মে, গত বছরের এই দিনেই আমার ছেলেটাকে হত্যা করা হয়েছিল। এক বছর পরেও সেই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষ হয়নি। গ্রেপ্তার হয়নি খুনিরা। অথচ পুলিশের হাতে রয়েছে অনেক সূত্রই। তার পরেও অদৃশ্য কারণে এখনো বড় কোনো অগ্রগতি চোখে পড়েনি। কেন পড়েনি, এই প্রশ্ন এখন কার কাছে করি! তার মধ্যে দেশে চলছে এই দুর্যোগ। প্রতিদিন চোখের সামনে মৃত্যু দেখতে পাচ্ছে মানুষ।
সন্তানের হত্যার শিকার হওয়া এবং তার বিচারের জন্য অপেক্ষা করা একজন পিতার জন্য যে কতটা কষ্টের, তা বুঝতে পারবে শুধু আরেকজন সন্তান হারানো পিতা। এ ছাড়া এ অনুভবের ক্ষমতা কারো নেই। এখন মাঝেমধ্যে মনে হয়, দায়িত্বশীল কারো যদি এমন বিষাদের সম্মুখীন করাতেন বিধাতা! পরক্ষণেই মনে হয়, এমন কষ্ট যেন শত্রুকেও না দেন তিনি। আমি তো বেঁচে আছি, অন্যের হয়তো তা সইবার ক্ষমতা না-ও থাকতে পারে।
গত বছর ২১ মে-র সকালে বাসা থেকে বের হলো ফাগুন। ভোরবেলা আমিই তুলে দিলাম। এগিয়ে দিলাম গলির মোড় পর্যন্ত। আমার চোখের সমুখ দিয়ে সটান হেঁটে গেল ছেলেটা। আমি কি জানতাম, এই পথে আর হেঁটে ফিরবে না সে। রাতে পাওয়া যাবে তার প্রাণহীন দেহ রেললাইনের ধারে। সারা রাত গাড়ি নিয়ে কত হাসপাতাল, কত থানায় খোঁজ নিয়েছি ওর। পাইনি। পরদিন বিকেলে খবর পেলাম, ফাগুনকে কবর দেওয়া হচ্ছে বেওয়ারিশ হিসেবে জামালপুর কবরস্থানে। বলুন তো, একজন পিতার মানসিক অবস্থা। আমি যে বেঁচে আছি, এই তো বেশি। এই যে লিখছি, আমার চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে উঠছে সমস্ত দৃশ্যপট। সে বর্ণনা আর লেখা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। একজন পিতার পক্ষে বারবার তার ছেলের মৃত্যু দেখা কী করে সম্ভব হয়!
অসম্ভব মেধাবী আমার ছেলেটা। সবকিছুই জানা চাই তার। প্রয়োজনীয় সবকিছুই তার জানা। সারা দিন পড়ার মধ্যেই ছিল সে। না, পাস করার জন্য পড়া নয়, জানার জন্য পড়া। সাহিত্য থেকে বিজ্ঞান, ধর্ম থেকে দর্শন সব পড়া চাই ওর। সব জেনে নেওয়ার চেষ্টা। জানার জন্য এতটা উদগ্রীব, এতটা আগ্রাসী আমি কাউকে দেখিনি। নিজ ছেলে বলে নয়, আমার নিজের পেশার খাতিরেই অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে আমার, তাই নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি
একদিনের ঘটনা বলি। আমার নিজের লেখার জন্য একটা বিষয়ে জানার প্রয়োজন হলো। গুগল ঘাঁটলাম, তেমন কিছু পেলাম না। একজন গুণী মানুষকে ফোন করলাম, না উনিও বেশি কিছু বলতে পারলেন না। যদিও ভরসা পাচ্ছিলাম না, তবু ফাগুনকে ফোন করে বললাম, এ ব্যাপারে জানিস কি না? মুহূর্তেই ঝরঝর করে বলে গেল সে বিষয়ের ওপর। মনে হলো কোনো বিশেষজ্ঞের কথা শুনছি। আশ্চর্য হওয়ার সঙ্গে গর্ব হলো। তবে তার প্রকাশ হতে দিলাম না। এমন ঘটনার কথা কয়টা বলব, অনেক রয়েছে। ওর কাছ থেকে অনেক বিষয় জেনে নিয়েছি আমি। এখনো লিখতে গিয়ে আটকে গেলে অজান্তে ফোনের দিকে হাত চলে যায়। হায়, ফাগুন। আমার অহংকার।
একটা একুশ বছরের তরুণের মধ্যে এতটা মেধা, এতটা সততা, এতটা প্রতিশ্রুতির সমন্বয় কীভাবে হয়, এটা এখনো আমি ভেবে উঠতে পারি না। এমন বিরল সমন্বয়ের কারণেই হয়তো প্রকৃতি চায়নি সে থাকুক। এক্সট্রিম বিশুদ্ধতা নাকি প্রকৃতি সইতে পারে না। হয়তো সে কারণেই আমার ছেলেটার চলে যেতে হয়েছে। বিচারহীনতার এমন পর্যায়ে এখন এসব ভেবেই সান্ত্বনা পেতে হয়। কী আর করার আছে। কাকে বলব, কার কাছে বলব আমার কষ্টের কথা, যাতনার কথা। সাগর-রুনির ছোট্ট মেঘ বড় হয়ে গেল বিচারহীনতার কষ্ট বুকে চেপে। তনু-মিতু এমন আরো কতজনের পিতামাতা-সন্তানের বুকে চেপে আছে কষ্টের পাথর। তাদের না হয় আমিও একজন।
এক বছর হয়ে গেল ফাগুন নেই, আমার বিশ্বাস হয় না। মনে হয় কাল রাতেও ডেকে বলেছে, আব্বুজি সেহরি খাবে না? এত চমৎকার করে ও আব্বুজি ডাকে। এখনো সেই ডাক স্পষ্ট শুনতে পাই, আর চমকে উঠি।
মাঝেমধ্যেই রাতের বেলা মনে হয় এই বুঝি ও এসে বলবে, আব্বুজি এটা কি তুমি জানো? না বাবা, আমি কিছুই জানি না রে। জানলে কি তোকে হারাতে হতো। মানুষ আসলে কিছুই জানে না, জানার ভান করে মাত্র। যারা জানে, তারা তোর মতো দূরে চলে যায়। প্রকৃতি চায় না, তাকে কেউ জেনে ফেলুক।
এমন দুর্যোগের কালে নিজেকে বড় অসহায় লাগে। ভরসার জায়গা না থাকলে অসহায় লাগারই কথা। আমার ছেলেটা ছিল আমার ভরসার জায়গা। আমার গার্ডিয়ান। আমার ভুল ধরিয়ে দেওয়ার, আমার সাহস জোগানোর উৎস। এখন নিজেকে ছাদহীন গৃহের মতো মনে হয়। এমন হবে কখনো কি ভেবেছিলাম। বারবার মনে হয়, আমি কেন? কখনো তো কারো অমঙ্গল কামনা করিনি। যতটা সম্ভব মানুষের ভালো করারই চেষ্টা করেছি। আমার ছেলেটা তো মানুষ কেন, কোনো প্রাণীরও ক্ষতি করেনি। রাস্তায় অভুক্ত কুকুরের জন্যও প্রাণ কেঁদেছে ওর। খাবার কিনে খাইয়েছে। তাহলে আমাদের কেন এমন হবে?
সারা জীবন ধরে মানুষের অধিকারের কথা বলেছি। আমার পিতাও বলতেন। মানুষের ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়িয়েছি, বলেছি আমরা সব সময়। এখনো মানুষের জন্যই লিখে যাচ্ছি। আমার ছেলেটাও সেই একই পথে চলা শুরু করেছিল। গণমাধ্যমে যোগ দিয়েছিল বাপদাদার পরম্পরা রাখতেই। মানুষের কথা বলতে, মানুষের অধিকারের কথা বলতে। হয়তো আমাদেরই ভুল ছিল। হয়তো আমরা ছিলাম ভুল পথে। এ দেশে অন্যের অধিকারের কথা বলার চেয়ে নিজের আখের গোছানোটাই সঠিক। মানুষের কথা বলার চেয়ে মেরেকেটে সেকেন্ড হোম বানিয়ে, গোঁফে তা দিয়ে চলার পথটাই ছিল সঠিক।
ছেলেটা আমার ইংরেজিতে এত ভালো ছিল। এ দেশের গণমাধ্যমে এমন ছেলে ছিল দুর্লভ। যে ছেলেটা সহজেই স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে যেতে পারত। আরাম-আয়েশে কাটাতে পারত জীবন। ক্ষেত্র তো প্রস্তুতই ছিল। কিন্তু না, ফাগুন চায়নি দেশ ছেড়ে যেতে। দেশের টানেই পড়ে ছিল সে। যেমন ছিল ওর দাদা। যেমন এত কিছুর পরেও রয়ে গেছে ওর বাবা, এই আমি। আমি নিজেও হয়তো আমার পিতার সঙ্গে নিজ নামকে ক্যাশ করে ঝোলে-ঝালে কাটাতে পারতাম জীবন। কিন্তু ওই যে সততা আর দেশপ্রেম। এ দুটি বিরল রোগের কারণেই হয়তো আমাদের এই অবস্থা! আমার ছেলেটাকেও সেই রোগের বলি হতে হলো। আমাদের মতো দেশে সততা ও দেশপ্রেম এ দুটো রোগ করোনার চেয়েও ভয়াবহ। আমাদের মতো দেশের মানুষের হয়তো এ দুই উপসর্গ থাকতে নেই। থাকা উচিত নয়।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও নিহত সাংবাদিক ফাগুন রেজার বাবা