সেগুন চাষে পানিশূন্য হচ্ছে পাহাড়
আপনি গুগলে সার্চ করলে সেগুনের নেতিবাচক বা ক্ষতিকর দিক নিয়ে তেমন লেখা পাবেন না। যৎসামান্য লেখা রয়েছে, যা সেগুন চাষের ইতিহাস, আদিনিবাস এবং কাঠের গুণাগুণ সম্পর্কে লেখা। অথচ সেগুন গাছের ক্ষতিকর দিক বহুমাত্রিক।
আপনি হয়তো শুনে অবাক হবেন, পাহাড়ে পরিবেশের বিষবৃক্ষ সেগুনের চাষ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় দ্রুতই পানিশূন্য হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে পাহাড়ের অনেক ছোট-বড় ছড়া, ঝিরি, ঝর্ণা মরে গেছে। অনেক ছড়ায় এখন ছয় মাসের বেশি পানি থাকে না। যদিও সেগুনকে বিষবৃক্ষ বলার পক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক যৌক্তিক বক্তব্য আমার কাছে নেই, কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক সমর্থনযোগ্য কিছু প্রমাণ রয়েছে।
চলতি সময়টা সেগুন চারা রোপণ মৌসুমের শেষ সময় চলছে। সাধারণত চৈত্র-বৈশাখ মাসে সেগুন চারা রোপণ করা হয়। এ বছর বৃষ্টি না থাকায় এখনও চলছে সেগুন চারা রোপণ। পরিবেশবাদীদের জন্য একটা সুখবর হলো, এ বছর সেগুন চারা রোপণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল। বিশেষ করে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ও মারিশ্যায় এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে বলে জানা গেছে। এ কারণে এ বছর সেগুন চারার দরপতন ঘটেছে আকাশ-পাতাল। গত বছর প্রতিটি সেগুন চারা (স্ট্যাম্প/ শিকড়) বিক্রি হয়েছিল পাঁচ থেকে ১০ টাকা। এ বছর চাহিদা না থাকায় এক থেকে তিন টাকায় নেমেছে।
নিষেধাজ্ঞা জারি করা রাজনৈতিক দলের বক্তব্য হলো, পাহাড়ে বিশেষ করে পাথুরে এলাকাগুলোতে একমাত্র পানীয় জলের উৎস ছড়া, ঝিরি ও ঝর্ণা। যেখানে বন উজাড় করে সেগুন বাগান করা হলে দ্রুত পানির উৎসগুলো মরে যাবে। কারণ, সেগুন এমন একটি বৃক্ষ, যে বৃক্ষ পানি শোষণ করে শূন্য করে দিতে পারে পানির স্তর। দীর্ঘদিন সেগুন চাষের সাথে জড়িত ও প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণকারীদের মতে, সেগুন প্রচুর পানি শোষণ করায় পানির স্তর একের পর এক নিচে নামতে থাকে। কেবল পানির স্তরই নিচে নামায় না, বহুমাত্রিক ক্ষতির দিক রয়েছে সেগুনের। সেগুনকে মূলত মনোকালচার পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। সেগুন গাছের ছায়া যেখানটায় পড়বে, সেখানটায় আর অন্য কোনো বৃক্ষ জন্মাতে পারে না। জন্মালেও তা বেড়ে উঠতে পারে না। সেগুন গাছ কাঠের জন্য উপযোগী হলেও পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।
অনেক বৃক্ষ রয়েছে, যেগুলোর শিকড় জালের মতো মাটিকে আটকিয়ে ধরে। যে কারণে অধিকাংশ গাছ মাটি ক্ষয়রোধ করতে পারে। কিন্তু সেগুনের জালের মতো বা ছোট ছোট শিকড় থাকে না। এ কারণে সেগুন মাটি ক্ষয়রোধ তো করতেই পারে না, উল্টো মাটি ক্ষয় করে আশঙ্কাজনকভাবে। সেগুন গাছ কাঠের উপযুক্ত হতে কমপক্ষে ২০-৩০ বছর সময় লাগে। এ দীর্ঘ সময়টাতে সেগুন গাছের গোড়ার মাটি কয়েক ফুট ক্ষয় হয়ে নিচে নেমে যায়। মনোকালচার পদ্ধতিতে চাষ হওয়ায় একটি সেগুন বাগানে কয়েক শত একর মাটি ক্ষয় হতে থাকে। আর পার্বত্য চট্টগ্রামে এ রকম হাজার হাজার সেগুন বাগান সৃজন হয়েছে।
সেগুন দীর্ঘমেয়াদি এবং মাঝারি থেকে বড় আকারের বৃক্ষ। এ বৃক্ষ ৩০-৫০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, সেগুনের আদি ক্ষেত্র বার্মা (মায়ানমার)। ১৮৭১ সালে প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে এ বৃক্ষ রোপণ করা হয়। পরে ১৮৭৩ সাল থেকে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট বনাঞ্চলে সেগুন লাগানো শুরু হয়। বর্তমানে দেশের প্রায় সর্বত্রই উন্নত মানের কাঠের বৃক্ষ হিসেবে এটি রোপণ করা হচ্ছে।
আশি দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারিভাবে ব্যাপক হারে সেগুন চারা রোপণ করা হয়। যখন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৭০ হাজার আদিবাসী বিতাড়িত হয়ে ভারতে শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করেছিল, ঠিক তখনই সরকার বনবিভাগের মাধ্যমে আদিবাসীদের জুমভূমিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা দিয়ে সেখানে সেগুন চারা রোপণ করে। বিশেষ করে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নে বন বিভাগ সেগুন রোপণ অভিযান চালায়। কাঠের চাহিদা থাকায় এ বৃক্ষ চাষের এমন ব্যাপকতা বেড়েছে, বর্তমানে প্রায় প্রত্যেকের সেগুন বাগান রয়েছে। এমনকি বাড়ির উঠানেও সেগুনের চাষ হচ্ছে।
বেশির ভাগ চাকরিজীবী পয়সাওয়ালারাই সেগুন বাগান সৃজনে ভূমিকা রাখছে। গরিব জুমচাষিদের জুমজমি কিনে নিয়ে সেখানে সেগুন বাগান গড়ে তুলছে। দেখা গেছে, সেগুনের ফল বা বিচি খাদ্য হিসেবে অনুপযোগী হওয়ায় সেগুন বাগানে খুব একটা পশু-পাখি বিচরণ করে না। কোনও সেগুন গাছে পাখিরা বাসা বাঁধে না।
সবচেয়ে আশঙ্কাজনক তথ্য হচ্ছে, পাহাড়ের অধিকাংশ জনপদে এখন বছরে পাঁচ থেকে ছয় মাস পানির জন্য হাহাকার করতে হয়। আগে পাড়ার খাদের ছড়াগুলোতে সারা বছর পানি থাকলেও খাদের কিনারে সেগুন বাগান সৃজিত হওয়ায় ছড়াগুলো শুকিয়ে মরে পড়ে আছে। পাড়ার নারীদের এখন পানির জন্য কয়েক কিলোমিটার দূরের ছড়া থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। সেসব ছড়াগুলোতেও বছরে পাঁচ থেকে ছয় মাসের বেশি পানি থাকে না। বাকি মাসগুলোতে পুরুষেরা দূরে নিম্ন এলাকায় গিয়ে গাড়ি করে পানি সংগ্রহ করতে হয়। মাঝেমাঝে জরুরি ভিত্তিতে রেড ক্রিসেন্ট, সেনাবাহিনীসহ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে গাড়িতে করে পানি বিতরণ করতে দেখা যায়।
অনাবৃষ্টি, মশার বংশ বৃদ্ধি, পানির স্তর নেমে যাওয়া, মাটিক্ষয়, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস; মোট কথা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়াকে সেগুন চাষকে বেশি করে দায়ী করেন অনেকে।
৯ মাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সূর্যশ্বর ত্রিপুরা জানান, তিনি দীর্ঘ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং পরীক্ষা করে দেখেছেন যে সেগুন বাগান আছে এ রকম এলাকায় নলকূপের জন্য গাড়তে (বোরিং) হয় ৮০-৯০ ফুট। বাঁশ বাগানের এলাকায় হলে তা মাত্র ৩০-৪০ ফুটের প্রয়োজন।
দীঘিনালার ভৈরফা নয়া পাড়ার কারবারি (গ্রাম প্রধান) শম্ভুধন ত্রিপুরা জানান, তিনি দীর্ঘ বছর ধরে সেগুন চাষে জড়িত আছেন। তিনি জানিয়েছেন সেগুনের অপকারিতার কথা। তাঁর মতে, যেখানে সেগুন চাষ করা হয়, সেখানে অন্য কোনও গাছপালা জন্মানো যায় না। আশপাশের পানির উৎস দ্রুতই শুকিয়ে যাবে। সেগুন বাগান থেকে গাছ কেটে নেওয়ার পরেও কমপক্ষে ১০-২০ বছর পতিত না রাখলে মাটি উর্বরতার ক্ষমতা ফিরে পায় না। তিনি সেগুনচাষিদের উদ্দেশে পরামর্শ দেন, সেগুনের চেয়েও লাভজনক এবং পরিবেশবান্ধব সুরুজ গাছের বাগান করতে। সুরুজ গাছ কাঠ উপযোগী হতে সময় লাগে মাত্র ১০-১২ বছর। অন্যদিকে, সেগুনের লাগে ৩০-৪০ বছর। কারবারি আরও পরামর্শ দেন, শিমুল গাছের বাগান করতে। এক প্রকার শিমুল গাছ আছে, যা দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং তুলা উৎপাদন করতে সক্ষম।
অন্যদিকে, সূর্যশ্বর ত্রিপুরার পরামর্শ, পানির স্তর বাঁচাতে হলে আমাদেরকে বাঁশ বাগান করা উচিত। কারণ, বাঁশ প্রতি বছর কেটে বিক্রি করা যায়। এতে করে ব্যক্তিগতভাবে যেমন লাভবান হওয়া যায়, তেমনই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অংশীদারত্বের ভূমিকা পালন করা যায়।
লেখক : মুক্ত লেখক