১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু, আমার বাবা ও শোকাবহ শূন্যতা
অশ্রুভেজা শোকাবহ ১৫ আগস্ট। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস। মুজিব আমার স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি, যে মানুষটির হাত ছুঁয়ে এসেছিল স্বাধীনতা। সবুজ মানচিত্র, লাল-সবুজের পতাকা, একটি দেশ। তাঁর কথা বলছি।
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই মুজিব; কে বলেছে মুজিব নাই, মুজিব সারা বাংলায়; এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে—স্লোগানগুলো আমার রক্তের সঙ্গে সতত প্রবহমান। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত যে মানুষটি থাকবে আমার প্রতিটি নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে। আমি কোনোদিন বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখিনি। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। কিন্তু এই দুঃখবোধ যেমন আমাকে কাঁদায়, ঠিক তেমনি মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু আমার প্রতিদিনের অহংকার।
আমার বাবার সৌভাগ্য হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পাওয়ার। আবার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু সেই গল্পগুলো কতবার যে শুনেছি বাবার মুখে। বঙ্গবন্ধু যে স্কুলে পড়াশোনা করতেন, আমার বাবাও পড়তেন একই স্কুলে। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর কয়েক বছরের ছোট। আমার বাবা প্রতিদিন মাইলের পর মাইল হেঁটে স্কুলে যেতেন। স্কুলে প্রথম বেঞ্চে বসতেন। কিন্তু কয়েকজন ছেলে প্রায়ই বাবার বইখাতা ফেলে পেছনে রেখে দিত। বাবা একদিন মুজিবকে এ বিষয়টি জানান। তার পর থেকে বাবা প্রতিদিনই প্রথম বেঞ্চে বসতেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে না দেখলেও এ রকম অনেক গল্পে বেড়ে উঠেছি বঙ্গবন্ধুর সাহস আর শক্তি নিয়ে। আমার বাবা আমাদের একটি লোহার তৈরি রড দেখাতেন আর বলতেন, এটি নিয়েই তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের জনসভায় রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলেন। সেই জনসভার গল্প আমরা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি।
আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, তখনো বঙ্গবন্ধুর একটি পোস্টার আমাদের বাসায় টাঙানো দেখতাম। পঁচাত্তরের সেই দুঃসময়েও বাবা পোস্টারটি নামাতে দেননি। অনেক আত্মীয়স্বজন এসে ভয় মাখানো কথা বলত। বাবা বলতেন, একবার তো একাত্তরে মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছেন। সে সময়ের দু-আনা দামের বঙ্গবন্ধুর সেই পোস্টারটি হৃদয়ের একেবারে গহিনে নিয়েই বড় হয়েছি।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে আমি ছোট ছিলাম। কিন্তু সে সময়ের বিভীষিকাময় দিনগুলোয় আমার আব্বা ভীষণ আহত হয়েছিলেন। তাঁর ভেতরের শূন্যতা এখনো অনুভব করি। শেখ সাহেবকে মেরে ফেলেছে ঘাতকেরা... তিনি ভাবতে পারছিলেন না। পাকিস্তানিরা যা করতে সাহস করেনি, এ দেশেরই কিছু লোক তা ঘটিয়েছে...।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ ’৭৫-এর ১৫ আগস্টে ঘাতকের নির্মম বুলেটে নিহত শহীদদের। ঘাতকেরা ভেবেছিল, জাতির পিতাকে হত্যা করলেই তাঁর নাম মুছে ফেলা যাবে এই বাংলায়। কিন্তু তারা বোঝেনি বঙ্গবন্ধুর আরেক নাম বাংলাদেশ।
১৫ আগস্ট শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসের বড় দুর্যোগ নয়, এটি সারা বিশ্বের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। যে নৃশংসতায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করা হয়েছিল, তার কোনো তুলনা বিশ্বের ইতিহাসে নেই।
যখন এ দেশে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামক কালো একটি আইন ছিল, সেটি বাতিলের জন্য খুব বেশি মানুষের মিছিল দেখিনি। টক শোতে না হোক, আজকের দিনের অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বের কজনই বা ছিলেন এই কালো আইনের বিরোধিতা করবার জন্য! কিন্তু সেই সাদাকালো পোস্টারে লেখা থাকত, কাঁদো বাঙালি কাঁদো/ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করো... সত্যিই বিচারের বাণী নিভৃতেই কেঁদেছে বছরের পর বছর। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়... সে সময় ১৫ আগস্টে হরতাল ডাকা হতো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ডাকে... আমরা হেঁটে হেঁটে যেতাম ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অথবা স্বেচ্ছায় রক্তদান অনুষ্ঠান আয়োজন করতে। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর বীরত্বের কথা বলতেন আনন্দ নিয়ে আর আমরা সন্তানেরা শুনতাম সেসব দিনের কথা। আমার বাবা কোনো নেতা ছিলেন না, কিন্তু সরকারের একেবারেই একজন সাধারণ কর্মচারী হিসেবে জীবন পার করে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু জীবনাচরণে ছিলেন সাহসী ও স্বাধীনচেতা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করল ১৯৯৬ সালে, তখন বিটিভি বেশ কিছু অনুষ্ঠান করেছিল ১৯৭১-এ নির্যাতিত মানুষের কাহিনি নিয়ে, মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। সে সময় আমার বন্ধু আব্দুন নূর তুষার একটি অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব পেয়েছিল। তুষার আমার বাবার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল সে সময়কে ধারণ করে। কিন্তু কয়েক দিন আগে জানতে পারি, সে সময়ের অনুষ্ঠানের কোনো কিছুই নেই আর্কাইভে।
আমার কষ্ট হয়েছিল শুনে। সেটিই ছিল আমার বাবার মিডিয়াতে প্রথম এবং শেষ সাক্ষাৎকার অথবা কথকতা। সেটিও তুষার বারবার অনুরোধ করায় বিটিভির স্টুডিওতে গিয়েছিলেন বাবা।
এ কথা মনে করার কারণ হলো, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল না, তখন অনেক বঙ্গবন্ধুর সৈনিককে দেখতাম, যারা কোনো কিছু চাওয়া-পাওয়ার হিসাব না করেই ৩২ নম্বরে ভিড় করত জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানাতে অথবা শেখের বেটিকে একনজর দেখতে। পরনে ময়লা কাপড়, হয়তো নব্য আওয়ামী লীগারদের মতো গুছিয়ে কথা বলতে পারত না, কিন্তু রিকশায় বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙিয়ে ৭ মার্চের ভাষণ শোনাত অবলীলায়। আমি সেসব মুখ খুঁজে ফিরি। আমাকে এখনো উজ্জীবিত করে সেসব দৃপ্ত শৃঙ্খলমুক্ত মুখ। পায়ে পায়ে যেন হারিয়ে না যায় সেসব মুখ।
লেখক : অধ্যাপক, হৃদরোগ বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়